- মূল: খিতাম আল আমির, চিফ নিউজ এডিটর, গালফ নিউজ
- অনুবাদ: হাসান আল মাহমুদ, চিফ রিপোর্টার, ৩৬ নিউজ
ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে টানা ১২ দিনের উত্তেজনা ও পাল্টাপাল্টি হামলার পর, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় একটি ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে। এই বিরতি এমন এক সংঘাতকে সাময়িকভাবে থামিয়েছে, যা পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে আরও বড় আকারের যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিয়েছিল।
কিন্তু গুলির শব্দ থেমে গেলেও প্রশ্ন থামেনি। এই সাম্প্রতিক সংঘাতে কার কী লাভ বা ক্ষতি হলো? কেউ কি কৌশলগতভাবে এগিয়ে গেল, নাকি আগের চেয়েও বেশি জটিলতায় আটকে গেল? এটা কি কূটনৈতিক উত্তাপ কমার ইঙ্গিত, নাকি পরবর্তী সংঘর্ষের আগে একটি বিরতি মাত্র?
বিশ্লেষকেরা কী বলছেন?
বিশ্লেষকেরা এখনও পরিস্থিতির মূল্যায়নে ব্যস্ত, এবং মতভেদ স্পষ্ট। কেউ এই সংঘর্ষকে শক্তির কৌশলগত প্রদর্শনী হিসেবে দেখছেন, আবার কেউ মনে করছেন এটি ছিল এক ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের কাছাকাছি গিয়ে থেমে যাওয়া — যেখানে উভয় পক্ষের দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে।
তবে যেটা স্পষ্ট, তা হলো — যে গভীর শত্রুতা ও দ্বন্দ্ব থেকে এই যুদ্ধ শুরু হয়েছিল, তার মূল কারণগুলো এখনও রয়ে গেছে অমীমাংসিত।
আটলান্টিক কাউন্সিলের স্কোক্রফট মধ্যপ্রাচ্য নিরাপত্তা উদ্যোগের পরিচালক জনাথন প্যানিকফ বলেন, ইরানের সামরিক সক্ষমতা এই হামলায় গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং ইসরায়েলও হয়তো তার সীমায় পৌঁছে গেছে। তিনি সম্ভাব্য কূটনৈতিক পথ খোলা থাকার কথা উল্লেখ করে বলেন — ওমান বা এমনকি চীনও মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারে। তবে তিনি সতর্ক করে দেন যে, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে বড় ধরনের সমাধান এখনো অধরা।
“এই অঞ্চলের ক্ষমতার ভারসাম্য এখন কিছুটা ইসরায়েলের দিকে ঝুঁকে গেছে এবং ইরান দুর্বল অবস্থানে গেছে,” বলেন প্যানিকফ।
শর্তসাপেক্ষ যুদ্ধবিরতি
ট্রাম্প ঘোষণা দেন, “যুদ্ধ শেষ বলে মনে হচ্ছে — আপাতত।” তবে এই বিরতির পেছনে যে ঘটনা ও উত্তেজনা ছিল, তা এ ঘোষণাকে পুরোপুরি নিশ্চিত করে না। ইসরায়েল ও ইরান দু’পক্ষই দাবি করছে, নিজেদের শর্তে এই যুদ্ধবিরতি এসেছে।
ইরান কি এই ধাক্কা সামলাতে পেরেছে?
ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র জয় দাবি করলেও, ক্ষয়ক্ষতির নিরপেক্ষ মূল্যায়ন এখনও পাওয়া যায়নি। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (IAEA) প্রধান রাফায়েল গ্রোসি জানান, এখনো পুরো মূল্যায়ন করা হয়নি। “ক্ষেপণাস্ত্রের বিস্ফোরণ ক্ষমতা এবং সেন্ট্রিফিউজের কম্পন-সংবেদনশীল প্রকৃতি বিবেচনায়, মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে বলেই ধরে নেওয়া যায়,” বলেন গ্রোসি।
IAEA জানায়, ৪০০ কেজি উচ্চমাত্রায় সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের বর্তমান অবস্থা নিয়ে উদ্বেগ আছে। অন্যদিকে তেহরান জোর দিয়ে বলছে, তাদের শান্তিপূর্ণ পরমাণু কর্মসূচির অধিকার অটুট রয়েছে এবং তারা যুক্তরাষ্ট্রকে ইসরায়েলের সঙ্গে মিলে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ করছে—ইসরায়েল নিজেই পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিতে (NPT) স্বাক্ষর করেনি।
ইরানের পরমাণু সংস্থার প্রধান মোহাম্মদ এসলামি জানান, এই হামলা সাময়িক ক্ষতি করলেও উৎপাদন ও সেবায় বিঘ্ন না ঘটানোর পরিকল্পনা আগেই ছিল এবং পুনরুদ্ধার কাজ শুরু হয়েছে।
একটি অনিশ্চিত শান্তি
যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও, দুই পক্ষের বক্তব্যে কোনো নমনীয়তা দেখা যাচ্ছে না। ট্রাম্প সরাসরি বলেন, ইরানের পরমাণু কর্মসূচি আবার চালু হতে দেওয়া হবে না। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুও হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, “ইরানে কেউ যদি সেই কর্মসূচি পুনরায় শুরু করতে চায়, আমরা একইভাবে কঠোর প্রতিক্রিয়া দেখাব।”
কাতারভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. উবায়দাহ আল শাম্মারী বলেন, “এই মুহূর্তে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি ভীষণ ভঙ্গুর।” তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, দুই পক্ষই হয়তো আবার সীমিতভাবে সংঘর্ষে জড়াতে পারে — একটি নির্ধারিত সীমার মধ্যে থেকে, পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে না গিয়ে।
“এটিকে ‘সমাধান’ ভাবা যাবে না,” বলেন আল শাম্মারী। “আমরা আসলে যা দেখছি, তা হলো একটি সংঘর্ষ বিরতি — সমাপ্তি নয়।” তিনি যোগ করেন, ইসরায়েল পরিকল্পিতভাবে সীমিত আঘাত চালিয়ে কূটনৈতিক চাপ বাড়ানোর কৌশল অবলম্বন করতে পারে।
সামনে কী আসছে?
এই মুহূর্তে একটি নড়বড়ে শান্তি বজায় আছে। কিন্তু তেহরান ও তেল আবিব নিজেদের অবস্থান থেকে পিছু না হটায় এবং যুক্তরাষ্ট্র ক্রমশ এই সংঘাতের ভেতরে ঢুকে পড়ায়, বিশ্লেষকরা সতর্ক করছেন — এই যুদ্ধবিরতি হয়তো সাময়িক, দীর্ঘমেয়াদে নয়।
হাআমা/