হাসান আল মাহমুদ >>
২০২৪ সালের ৫ই আগস্ট যাত্রাবাড়ী থানার সামনে ফ্যাসিস্ট সরকারের পেটোয়া বাহিনীর গুলিতে শহীদ হন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা খোবাইব বিন আব্দুর রহমান (রহ.)। তাঁর শাহাদাতের স্থানসংলগ্ন এলাকায় আজ তাঁর নামানুসারে একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
‘শহীদ খোবাইব বিন আব্দুর রহমান রহ. ওয়াক্তিয়া মসজিদ’—এই নামে যাত্রাবাড়ীর স্থানীয় একটি ওয়াক্তিয়া মসজিদকে প্রতীকীভাবে নামকরণ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে ৩৬ নিউজকে নিশ্চিত করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক শেখ ইনামুল হাসান।
তিনি বলেন, ‘আজ আমরা শহীদ খোবাইব (রহ.)-এর নামে এ মসজিদের নামকরণ করেছি। স্থানীয় বড় মাদরাসার ছাত্র ও শিক্ষকদের সঙ্গে নিয়ে এই উদ্যোগ নিয়েছি।’
তিনি আরও বলেন, “এটি আপাতত একটি প্রতীকী নামকরণ। এলাকাবাসী অনেক আগে থেকেই এখানে নামাজ আদায় করছেন, কিন্তু মসজিদের কোনো নির্দিষ্ট নাম ছিল না। এখন আমরা এটি শহীদ খোবাইবের নামে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠা করতে চাই।”

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদ্য গঠিত নতুন নেতৃত্ব
শেখ ইনামুল হাসান জানান, “আমরা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে মসজিদটির স্বীকৃতি ও স্থায়ীকরণ প্রক্রিয়া শুরু করবো ইনশাআল্লাহ। আশা করছি, খুব শিগগিরই এ বিষয়ে ইতিবাচক অগ্রগতি হবে।”
তিনি বলেন, “শহীদ খোবাইব ছিলেন বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইরত প্রজন্মের এক সাহসী প্রতিনিধি। তাঁর স্মৃতি ধরে রাখতে এই মসজিদ একটি জীবন্ত প্রতীক হয়ে থাকবে।”
কে ছিলেন শহীদ খোবাইব?
খোবাইব বিন আব্দুর রহমানের বাড়ি চাঁদপুর জেলার কচুয়া উপজেলার উজানি গ্রামের ঐতিহ্যবাহী দেওয়ান পরিবারে। পিতা মাওলানা আব্দুর রহমান একজন প্রখ্যাত ইসলামি চিন্তাবিদ ও বক্তা। তিনি কচুয়ার উজানি মাদ্রাসার শিক্ষক এবং যাত্রাবাড়ীর কাদলার পাড় জামেয়া ইসলামিয়া ইব্রাহিমিয়া ইছহাকিয়া মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা ও মোহতামিম।
২১ বছর বয়সী খোবাইব ছোট ভাইদের মধ্যে সবার কনিষ্ঠ ছিলেন। ২০২৪ সালেই তিনি দাওরায়ে হাদিস শেষ করেন এবং বাবার প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসায় শিক্ষকতা শুরু করেন।
মৃত্যুর কিছুদিন আগে মা-বাবার সাথে খোবাইবের কথোপকথনে শহীদের নাম রাখা নিয়ে এক আবেগঘন প্রসঙ্গ উঠে আসে। মা তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তাঁর নাম খোবাইব কেন রেখেছেন? উত্তরে খোবাইব বলেছিলেন, “এটা তো একজন শহীদের নাম। তাহলে আমিও শহীদ হবো।” এই কথাটিই পরে বাস্তবে রূপ নেয়।

শহীদ খোবাইব বিন আব্দুর রহমান রহ.
শহীদের শেষ দিন
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিকেলে যাত্রাবাড়ী ওভার ব্রিজের উত্তরে খোবাইব পায়ে হেঁটে যাওয়ার সময় পুলিশের গুলিতে গুলিবিদ্ধ হন। তাঁর পেটে গুলি লাগে এবং ঘটনাস্থলেই তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। পরে স্থানীয়রা তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শাহাদাত বরণ করেন।
তার পিতা মাওলানা আব্দুর রহমান কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমি জানতাম না খোবাইব কখন মিছিলে গেছে। আমাদের মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা বিজয় মিছিলে যেতে চায়, তাই গেট খুলে দেওয়া হয়। সবাইকে বলেছিলাম আলাদা হয়ে যেন যায়। কিন্তু খোবাইব কখন বের হলো, বুঝতেই পারিনি।’
তিনি বলেন, ‘খবর পাই সন্ধ্যার দিকে, যাত্রাবাড়ীর ওভার ব্রিজের উত্তরে গুলি খেয়ে সে পড়ে গেছে। এরপর হাসপাতালে নেওয়া হলে ডাক্তাররা জানান, সে আর বেঁচে নেই। আমরা তার দেহ মাদ্রাসায় নিয়ে আসি এবং সেখানে জানাজা শেষে দাফন করি।’
নীরব গ্রাম, গর্বিত স্মৃতি
শহীদ খোবাইবের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার উজানি গ্রামের দেওয়ান বাড়ি এখন অনেকটা নিরিবিলি। প্রধান ফটকে তালা, আঙিনায় জমে থাকা শুকনো পাতার স্তূপ—সবই যেন এক গর্বিত শোকের প্রতীক।
স্থানীয়রা জানান, এই পরিবার অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ, নারীরা পর্দানশীল, অথচ এলাকার সব শ্রেণিপেশার মানুষের সঙ্গে তাদের রয়েছে সুসম্পর্ক।
এক প্রতিবেশী শাহ জালাল, যিনি সিএনজি চালক, বলেন, ‘আমরা খোবাইবকে ছোট থেকে চিনি। আমাদের সামনেই বড় হয়েছে। তার শহীদের খবর শুনে এলাকাজুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছিল।’
হাআমা/