আলী হাসান তৈয়ব >>
সম্প্রতি দেশে চাঁদাবাজি, ধর্ষণ ও বীভৎস কায়দায় খুনের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে অপরাধীদের প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া দাবি জোরালো হয়ে উঠছে। বিশেষত, পুরান ঢাকায় পাথর মেরে হত্যার ঘটনায় নাগরিকদের ক্ষোভ সীমা ছাড়িয়ে গেছে। বিভিন্ন বিক্ষোভ-মিছিল ও সভা-সমাবেশ থেকে ইসলামি আইনে খুনিদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার দাবি উঠছে। ইসলামে ঠিক এই বিধানই রয়েছে। রয়েছে হত্যার বদলে হত্যার আইন। কোরআনে কারিমে মহান আল্লাহ নিজে এই বিধান জারি করেছেন। এর নাম হলো কিসাস।
কোরআনের পরিভাষায় ‘কিসাস’ শব্দের অর্থ হলো প্রাণের বদলে প্রাণ। কেউ একজনকে অন্যায়ভাবে খুন করেছে বলে তা বিচারে প্রমাণিত ব্যক্তিকে সমমানের শাস্তি প্রদান ইসলামের বিধান।
এ মর্মে পবিত্র কোরআনের যে আয়াতে মৃত্যুদণ্ডের বিধানটি বর্ণিত হয়েছে তা হলো, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইরশাদ করেন, ‘হে মুমিনরা, নিহতদের ব্যাপারে তোমাদের ওপর ‘কিসাস’ ফরজ করা হয়েছে। স্বাধীনের বদলে স্বাধীন, দাসের বদলে দাস, নারীর বদলে নারী। তবে যাকে কিছুটা ক্ষমা করা হবে, তার ভাইয়ের পক্ষ থেকে, তাহলে সততার অনুসরণ করবে এবং সুন্দরভাবে তাকে আদায় করে দেবে। এটি তোমাদের রবের পক্ষ থেকে সহজীকরণ ও রহমত। সুতরাং এরপর যে সীমালঙ্ঘন করবে, তার জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক আজাব। আর হে বিবেকসম্পন্নরা, কিসাসে রয়েছে তোমাদের জন্য জীবন, আশা করা যায় তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করবে।’ (সুরা বাকারা : ১৭৮-১৭৯)
হত্যার বদলায় প্রাণদণ্ডের মধ্যে রয়েছে জীবনের নিরাপত্তা। আর যৌক্তিকভাবেই এর কার্যকারিতা প্রমাণিত। যেমন ধরা যাক, কয়েক বছর আগে বাংলাদেশে এরশাদ শিকদার নামে এক ব্যক্তিকে ৬০টি খুনের অপরাধে দেশের বিচার বিভাগ মৃত্যুদণ্ড দেয়। পরে দেশজুড়ে আলোচিত সে রায় কার্যকরও করা হয়। এ ক্ষেত্রে যদি প্রথম হত্যাকাণ্ডের পরই পবিত্র কোরআনের দণ্ডবিধি মোতাবেক বিচার করে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হতো, তাহলে ৫৯টি নিরপরাধ মানুষের প্রাণ রক্ষা পেত।
অথচ কোরআনের এই নিরপেক্ষ অপরাধ-দণ্ডবিধি সমাজে চালু নেই বলে সমাজে অপরাধ শুধু বেড়েই চলেছে। এই আইনের বিকল্প হিসেবে মানব রচিত অপরাধ-দণ্ডবিধিগুলো অপরাধ নির্মূল বা হ্রাসে আজ পর্যন্ত তেমন কার্যকর ও সফল প্রমাণিত হয়নি। বস্তুত এ কারণেই যখন প্রতিবছর বিশ্বের অপরাধমূলক ঘটনার পরিসংখ্যান বের হয়, তখন দেখা যায়, অন্য দেশের তুলনায় সৌদি আরবে হত্যাকাণ্ডসহ অপরাধমূলক ঘটনার অনেক কম থাকে।
মহান আল্লাহ তার বান্দার প্রতি পরম অনুগ্রহশীল এবং তিনি চান না যে তার বান্দারা কোনো অন্যায়-অবিচার বা পাপকাজে লিপ্ত হয়ে দণ্ডিত হোক। তাই তিনি এ জাতীয় চরম শাস্তি থেকে তাদের রক্ষার নানা বিকল্প ব্যবস্থাও রেখেছেন। কোনো খুনির এই কিসাসের বেলায়ও তাই দেখা যায় তিনি এই বিধান দিয়েছেন— নিহত ব্যক্তির অভিভাবকরা যদি খুনি থেকে রক্তমূল্য হিসেবে ক্ষতিপূরণ বাবদ অর্থ নিয়ে তাকে ক্ষমা করে দেয় অথবা রক্তমূল্য ছাড়াই তাকে ক্ষমা করে দেয়, তাহলে এটারও তিনি অবকাশ রেখেছেন। কিন্তু নিহত ব্যক্তির অভিভাবকরা যদি রক্তমূল্য না নিয়ে খুনিকে মাফ করতে সম্মত না হয়, তাহলে তাকে কোরআনের ‘কিসাস’ আইন মোতাবেক মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় এবং অপরাধের তারতম্য হিসেবে জরিমানা প্রদান অথবা বিভিন্ন মেয়াদে সে কারাদণ্ড ভোগ করে।
প্রসঙ্গত, সব ধরনের বৈষম্যবোধের ঊর্ধ্বে মানবস্রষ্টা মহান আল্লাহ তাঁর বান্দার নিরাপত্তা বিধানে খুন ও যাবতীয় অপরাধ দমনে যেসব বিধান প্রদান করেছেন, ন্যায়বিচারের দিক থেকে তা অতুলনীয় ও অনন্য। যেকোনো মুসলমান এমনকি ইনসাফসম্পন্ন যেকোনো মানুষই বিনাবাক্যে তা স্বীকার করে নিতে বাধ্য।
কিসাস আইনের আরেকটি সৌন্দর্য হলো, ইসলাম হকদারের হক রক্ষার্থে ক্ষমা করার অধিকার শুধু হকদার পর্যন্তই সীমাবদ্ধ রেখেছে। অপরদিকে ইসলাম তাকে ক্ষমা করতে উদ্বুদ্ধ করেছে। আর অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হত্যাকারী যথেষ্ট শিক্ষা পাওয়ার পর দণ্ড কার্যকরের প্রাক্কালে তাকে ক্ষমা করা হয়। ইচ্ছাকৃত হত্যা বা পরিকল্পিত হত্যা ক্ষমা করার বিধানও ইসলাম দিয়েছে, যা বাকারার ১৭৮ নম্বর আয়াতে অতি চমৎকারভাবে বর্ণিত হয়েছে। বলা হয়েছে, ক্ষমা করার অধিকারী নিহতের হকদাররা ছাড়া আর কেউ নন। কেবল তিনিই ক্ষমা করতে পারেন রক্তপণ নিয়ে কিংবা রক্তপণ ছাড়াই। অথচ বৃটিশপ্রণীত বাংলাদেশের আইনে খুনিকে ক্ষমা করার অধিকার দেওয়া হয়েছে রাষ্ট্রপতিকে। যা সুস্পষ্ট জুলুম। খুন হয়েছে আমার ভাই আর তাকে ক্ষমা করার কর্তৃপক্ষ রাষ্ট্রপতি! এটা কেমন ইনসাফ!
সুতরাং নিরপরাধ মানুষকে স্বেচ্ছায় হন্তারকের অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড একটি কার্যকর প্রতিকার। আর বিনা অপরাধে অনেক নিরীহ ব্যক্তি হত্যার শিকার হওয়ার চেয়ে ন্যায়ানুগ বিচার ও যথোপযুক্ত তদন্ত-প্রমাণের পর কঠোর শর্তসাপেক্ষে ও সুনির্দিষ্ট নীতিমালার আলোকে একজন অপরাধীকে হত্যার এখতিয়ার দেওয়া অনেক উত্তম, যে অপরাধ স্বীকার করে নেয় খোদ অপরাধী বা তার দল। আল্লাহতায়ালা এ বাস্তবতাকে সমর্থন করে বলেন, ‘আর হে বিবেকসম্পন্নরা, কিসাসে রয়েছে তোমাদের জন্য জীবন, আশা করা যায় তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করবে।’ (সুরা বাকারা : ১৭৯)
অতএব কিসাস প্রকৃতপক্ষে অনেক নিরপরাধ মানুষের জীবনের নিরাপত্তা দেয়, অনেক সময় সীমালঙ্ঘনকারী ও অপরাধীরা জুলুম বা সীমালঙ্ঘনবশত যাদের ওপর হাত ওঠায়। তেমনি তা অনেককে জীবনদান করে, যারা অন্যের হত্যার ক্রোধ প্রকাশে অসংযত। কিসাস তাদের সেই হত্যাকাণ্ড ঘটানোর আগে শতবার ভাবতে বাধ্য করে যে এর পরিণাম শেষ পর্যন্ত মৃত্যুদণ্ডে গিয়ে দাঁড়াবে।
এ শাস্তির দ্বারা ইসলাম শান্তিপ্রিয় নিরীহ ব্যক্তিদের অবৈধ হত্যার ঝুঁকি ও হুমকি রোধ করে, যা করতে ব্যর্থ আধুনিক মানবরচিত আইনগুলো।
সুতরাং বলাবাহুল্য, মানবের স্রষ্টা আল্লাহর চেয়ে আর কারও আইন মানবের জন্য অধিক কল্যাণকর হতে পারে না। আল্লাহ আমাদের বোঝার তাওফিক দান করুন।
সূত্র: দৈনিক আমার দেশ।
এআইএল/