আমিরুল ইসলাম লুকমান >>
কওমি মাদরাসার শিক্ষা ব্যবস্থা এমন এক শিক্ষা ব্যবস্থা; যেখানে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার সব বিষয়ের মৌলিক ও বিস্তারিত একাডেমিক পাঠ দান করা হয়। ইবাদত, অর্থনীতি, বিচার-মামলা, রাষ্ট্রনীতি-রাজনীতি, পরিবারনীতি ও উত্তরাধিকারসহ যাপিতজীবনের সব বিষয়ে সুন্দর ও সঠিক নির্দেশনা কওমি মাদরাসার সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত আছে। নবী করিম সা. এর যুগ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত পৃথিবীর উন্নতি-অগ্রগতি, সভ্যতা-সংস্কৃতি নির্মাণ ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষের পথ দেখিয়েছে ইসলামি শিক্ষার এ ধারা।
কুরআন-হাদিসের একাডেমিক শিক্ষা ও প্রয়োগিক চর্চার যত পদ্ধতি পৃথিবীজুড়ে চালু আছে, তার একটি কার্যকরী ও ব্যাপক সফল পদ্ধতির নাম ‘কওমি শিক্ষা’ ব্যবস্থা। আরববিশ্ব, ইউরোপ-আমেরিকা, আফ্রিকা-অস্ট্রেলিয়াসহ পুরো দুনিয়ায় এ শিক্ষা ব্যবস্থার শাখা-প্রশাখা পাওয়া যায়। এটা কওমি শিক্ষা ব্যবস্থার সফলতার বড় প্রমাণ। কওমি শিক্ষা ব্যবস্থা মানবজাতিকে ‘মানুষ’ রূপে তৈরি করার জন্য তার সমস্ত শ্রম ব্যয় করে থাকে।
বর্তমান বাংলাদেশের সামাজিক পরিমণ্ডলে একটি অভিযোগ বারবার উত্থাপনের চেষ্টা করা হয় যে, মাদরাসার শিক্ষা ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপরিচালনা, বিচার ব্যবস্থা ও অর্থনীতি বিষয়ে কোনো শিক্ষা দেওয়া হয় না। তাহলে আলেম-উলামা ও ইসলামি দলগুলো রাষ্ট্রক্ষমতায় আসলে জাতির কী উপকার হবে। মানুষ কেন ইসলামি দলগুলোকে ক্ষমতাশীল হিসেবে মেনে নেবে?
সম্প্রতি প্রবাসী সাহসী সাংবাদিক ইলিয়াস হোসাইন তার এক লাইভ অনুষ্ঠানে এ ধরনের কিছু অবাস্তব, অসত্য ও অজ্ঞতাপ্রসূত প্রশ্ন তুলে মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা ও আলেম উলামাদের প্রতি তীব্র তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশের আলেম সমাজকে সাংবাদিক ইলিয়াস হোসাইনের অজ্ঞতার প্রতি আক্ষেপ ও তার মিথ্যাচারের প্রতিবাদ জানাতে দেখা গেছে।
বাংলাদেশের কওমি মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় আধুনিক অর্থনীতি ও ইসলামী অর্থনীতি এবং ইলিয়াস হুসাইনের ওই টকশোতে উচ্চারিত কিছু বিষয় নিয়ে এ লেখায় আলোচনা করার চেষ্টা করবো।
এক.
ইলিয়াস হোসাইন ভাইকে আমরা জানি একজন সাহসী সাংবাদিক হিসেবে। আওয়ামী লীগের জুলুম, খুন, গুম, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, বিদেশে বসেও এমন কিছু রিপোর্ট তিনি জাতির সামনে তুলে ধরেছেন, যার মাধ্যমে সেসব মামলার মুখোশ খুলে গেছে। জাতি প্রকৃত সত্য জানতে পেরেছে। অনুসন্ধানী ও সাহসী সাংবাদিক হিসেবে তিনি জনপ্রিয় ব্যক্তি। বিপুল সংখ্যক মানুষ তার ভিডিও দেখেন, তার কথা বিশ্বাস করেন। ইসলামপ্রিয় মানুষের প্রতিও তার আবেগ, ভালোবাসা প্রকাশ পেয়েছে। জেলবন্দী আলেমদের মুক্ত করতে তিনি চেষ্টা করেছেন। এসবের জন্য তিনি অনেক প্রশংসারযোগ্য।
সাংবাদিক ইলিয়াস হোসাইনের বিরুদ্ধে আগেও অভিযোগ ছিল, তিনি অভদ্রচিত ভাষা ব্যবহার করেন। যাকে-তাকে অশ্লীলভাবে আক্রমণ করেন। সম্প্রতি একটি টকশোতে তিনি দেশের প্রধানসারির শ্রদ্ধাভাজন একজন আলেমকে যে অশ্লীলভাবে আক্রমন করে কথা বলেছেন, তা অত্যন্ত জঘন্য পর্যায়ের নোংরামি। যেকোনো ব্যক্তির সাথে দ্বিমত থাকতে পারে, অভিযোগ থাকতে পারে, এমনকি কোনো ব্যক্তিকে পসন্দ নাও হতে পারে; কিন্তু তার ব্যাপারে কথা বলতে গিয়ে অসভ্য, অভদ্র, অশ্লীলভাবে কথা বলতে হবে, এটা কেমন কথা? ইসলামি পরিভাষায় ‘আদাবুল ইখতিলাফ’ বলে একটি বিষয় আছে, ইলিয়াস ভাইতো এটা বুঝবেন না, কমপক্ষে মতবিরোধ-বিতর্ক করার যে স্বাভাবিক নীতিমালা আছে, সেটা তিনি অনুসরণ করবেন বলে আশা করি।
তিনি তো আলেম সমাজের শত্রু না। আলেম সমাজও তাকে শত্রু মনে করেন না। তিনি আলেম সমাজ, বাংলাদেশপন্থি জনগণের একটি শক্তির জায়গা ছিলেন। হয়তো তিনিও আলেম সমাজকে একটি শক্তিশালী স্থানে দেখতে চান। কিন্তু তার ভালোবাসা বা চাওয়াটা ‘জুতা মেরে সম্মান’ জানানোর মত হয়ে গেছে। তার নিজের কোনো আচরণের কারণে, কোনো অযাচিত ব্যবহারের করণে, কোনো অবান্তর ভিত্তিহীন অভিযোগ আরোপের কারণে সেটা যেন নষ্ট না হয়, সেদিকে তিনি খেয়াল রাখবেন বলে আমরা আশা করি।
অন্যের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ঘাটাঘাটি করলে কে নিরাপদ থাকবে? দুনিয়ার কেউ নিরাপদ থাকবে না। অন্যের ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে আক্রমণ করা তো এমনিতেই ছোটলোকি কাজ। এসব বন্ধ না করলে ইলিয়াস ভাই মুখ থুবড়ে পড়বেন বলে আশংকা আছে।
ইলিয়াস হোসাইন তার বক্তব্যে শ্রদ্ধেয় আলেম সম্পর্কে যে অভিযোগ করেছেন, সেটা সত্য নয়। তিনি তার ভুল ধারণা, মিথ্যা জানার ওপর ভিত্তি করে অভিযোগ করেছেন। আলেম সমাজের যারা খোঁজ-খবর রাখেন, তারা জানেন, মজলুম ওই আলেম অনেক বন্দী আলেমের মুক্তির ব্যাপারে চেষ্টা করেছেন, এখনো করছেন। হেফাজতে ইসলামের বন্দীদের ব্যাপারে কিছুদিন আগে একজন উপদেষ্টা যে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে দেশের শ্রদ্ধাভাজন আলেম সমাজের প্রতি ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষ ও তৃণমূল আলেম সমাজকে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন, সে ব্যাপারেও আমরা তার কাছ থেকেই সত্যটা জানতে পেরেছিলাম। মাত্র কয়েকদিন আগেও আমরা তার কাছ থেকে কারাবন্দী আলেমদের মুক্তির ব্যাপারে নতুন কিছু তথ্য ও আশার বাণী শুনেছি।
ইলিয়াস ভাই যার ব্যাপারে অভিযোগ তুলেছেন, আমরা জানি, সেসব সত্য নয়। তিনি নিজের মত করে মিথ্যা অভিযোগ তুলে আলেমদের লাঞ্ছিত ও অপমানিত করার চেষ্টা করেছেন। মনে রাখতে হবে, ইলিয়াস হোসাইন বাদে অন্য সবাই হাসিনা না।
দুই.
ইলিয়াস হোসাইন অভিযোগ তুলেছেন, মাদরাসায় অর্থনীতি পড়ানো হয় না, কুরআনে অর্থনীতি সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। মাদরাসায় রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়ানো হয় না, বাংলাদেশের মানুষ কেন অযোগ্য-অশিক্ষিত হুজুরদের ক্ষমতায় বসাবে? তিনি অনেক অভিযোগ তুলেছেন, সব নিয়ে কথা বলা এখন সম্ভব নয়, মাত্র কয়েকটি পয়েন্ট নিয়ে কথা বলবো।
কুরআনে অর্থনীতির কথা নেই, এ কথাটি ডাহা মিথ্যা, ইলিয়াস ভাইয়ের অজ্ঞতা বা মূর্খতা। তিনি কুরআনের সাথে সম্পর্কহীন একজন মুসলমান। তার কথার ভেতর প্রচ্ছন্নভাবে ‘ইসলাম পূর্ণাঙ্গ ধর্ম’- এ কথার অস্বীকার ফুটে উঠেছে। কুরআনের অসংখ্য স্থানে অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি অর্থনীতি ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা রয়েছে। সুরা ইউসুফে কৃষি অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা আছে। সুরা কুরাইশে বাণিজ্য নিয়ে আলোচনা আছে, সুরা বাকারায় অর্থনীতি-সুদি অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা আছে। সুরা লাইলে আছে। সুরা নিসায় আছে। সুরা নুরে আছে। আরো অনেক সুরায় আছে।
হাদিসের সুবিশাল ভাণ্ডারে প্রায় প্রতিটি হাদিসের কিতাবে ‘কিতাবুল বুয়ু’ (ক্রয়-বিক্রয়, ব্যবসা-বাণিজ্য, লেনদেন) নামে অধ্যায় রয়েছে। যেসব হাদিসের কিতাব সরাসরি কওমি মাদরাসার ক্লাসে পড়ানো হয়, সেগুলোর প্রতিটি কিতাবে ক্রয়-বিক্রয়ের অধ্যায় আছে। বিশেষভাবে সহিহ বুখারি ও সহিহ মুসলিমে গুরুত্বের সাথে অর্থনীতি পড়ানো হয়।
কওমি মাদরাসার সিলেবাসে ‘ফিকহি’ অনেক কিতাব পড়ানো হয়। মানুষের জীবনের যেকোনো প্রশ্নের ইসলামি সমাধান দেওয়ার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় যে কিতাবের মাধ্যমে, সেগুলিকে ‘ফিকহি কিতাব’ বলে। মাওলানা হতে গেলে যতগুলো বছর লেখাপড়া করা লাগে (ক্লাস ফাইভের পর আরো দশ বছর), তার প্রতি বছর একটি-দুটি কিতাব ‘ফিকহ-মাসয়ালা-ফতোয়া’ সম্পর্কে থাকে। এ কিতাবগুলিতে ইসলামি অর্থনীতি, আধুনিক অর্থনীতি বিষয়ে ক্লাস হয়ে থাকে।
এছাড়া (তাকমিল-মাস্টার্সের পর) উচ্চতর গবেষণা ক্লাসগুলোতে (তাখাসসুস) স্বতন্ত্রভাবে আধুনিক-প্রচলিত অর্থনীতি, আরববিশ্বের অর্থনীতি, ইসলামি অর্থনীতি নিয়ে বিশদ পাঠদান করা হয়ে থাকে। গবেষণা হয়ে থাকে।
তাহলে বোঝা গেল, ইলিয়াস ভাই কওমি মাদরাসার সিলেবাস সম্পর্কে কোনো ধারণা না নিয়ে, কোনো অনুসন্ধান না করে, কোনো যাচাই না করেই অভিযোগের বিষাক্ত তীর ছুড়েছেন। তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য প্রকাশ করেছেন। অথচ এটা তার নিতান্তই অজ্ঞতা, পরিষ্কার মূর্খতা।
বাংলাদেশের অনেক ব্যাংক-বীমার বিভিন্ন পর্ষদে অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ আলেমগণ কাজ করছেন। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি হয়ে তারা দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ট্রেনিং, সফর ও চুক্তি করছেন। তারা আধুনিক অর্থনীতি ও ইসলামী অর্থনীতিতে পারদর্শী না হলে এত বড় সেক্টরে কীভাবে কাজ করছেন? মুফতি শাহেদ রাহমানি, মাওলানা উবাইদুল্লাহ হামযাসহ অন্যরা এর উজ্বল উদাহরণ।
আধুনিক অর্থনীতি ও ইসলামি অর্থনীতিতে সমান পারদর্শী এমন উলামায়ে কেরাম গবেষণা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন। দেশের সুনামধন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করছেন। দেশ-বিদেশ থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্ত এ সকল উলামায়ে কেরাম ইতোমধ্যে দেশের অর্থনীতি খাতে বেশ সাফল্য ও সুনাম অর্জন করেছেন। মুফতি ইউসুফ সুলতান (মালিবাগ), মুফতি আব্দুল্লাহ মাসুম (মালিবাগ মাদরাসা), মুফতি মাসুম বিল্লাহ (আকবর কমপ্লেক্স)সহ আরো অনেকে আধুনিক অর্থনীতি, ইসলামী অর্থনীতি বিষয়ে সফলতা দেখিয়েছেন। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করছেন।
তাহলে বোঝা গেল, ইলিয়াস হোসাইন কওমি সিলেবাস সম্পর্কে, উলামায়ে কেরামের খেদমত, কৃতিত্ব, মেহনত, গবেষণা সম্পর্কে খোঁজ খবর না নিয়েই তাদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ উপস্থাপন করেছেন। অত্যন্ত নীচুতার পরিচয় দিয়ে উলামায়ে কেরামকে অযোগ্য প্রমাণের কুচেষ্টা করেছেন।
ইলিয়াস ভাই কি বাংলাদেশের কোনো ব্যাংকে কখনো যাননি, লেনদেন করেননি? করে থাকলে ‘মুদারাবা’ ‘মুশারাকা’ ‘ওয়াকফ জিপোজিট’ ‘মুরাবাহা’ ‘আমানত’ ইত্যাদি শব্দ তার চোখে পড়ার কথা। প্রায় প্রতিটি ব্যাংকে, বিশেষ করে ইসলামি ব্যাংকিং যারা করেন তাদের সবার হাউজে নানা পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুনে এসব শব্দ ভরপুর লেখা থাকে। এসব শব্দ ইসলামি অর্থনীতিরই শব্দ। বর্তমান আধুনিক অর্থনীতি ইসলামী অর্থনীতি নিয়েই চলছে। তাহলে ইসলামে অর্থনীতি নেই বা আলেম সমাজ অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করেন না, এসব কথা বলা নিজের ‘হেডম’ জাহির করে অন্যের কৃতিত্ব অস্বীকার করার কুৎসিত প্রকাশ, সম্পূর্ণ অজ্ঞতা, মূর্খতা ও নোংরামি।
বাংলাদেশের অনেক মাদরাসা থেকে মাসিক-পাক্ষিক-সাময়িক পত্রিকা বের হয়ে থাকে। গবেষণাপত্র, প্রবন্ধ সংকলন, স্মরণীকার বিশেষ সংখ্যা বের হয়। যেমন মাসিক আল কাউসার, মাসিক আল আবরার, মাসিক মুঈনুল ইসলাম, মাসিক আল জামেয়া, মাসিক নসিহত ইত্যাদি। এসব পত্রিকায় প্রশ্ন-উত্তর নামে বিভাগ থাকে। এ বিভাগে দেশ-বিদেশ থেকে অসংখ্য মানুষ ইসলামি অর্থনীতি, আধুনিক অর্থনীতি নিয়ে প্রশ্ন করে থাকেন। দেশের আলেমগণ, সুযোগ্য মুফতি সাহেবগণ, ফতোয়া বিভাগের দায়িত্বশীলগণ আধুনিক অর্থনীতির এসব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে থাকেন। যদি মাদরাসায় আধুনিক অর্থনীতি পড়ানো না-ই হয়ে থাকে, কুরআনে যদি অর্থনীতির কোনো কথা নাই বলা থাকে, তাহলে আধুনিক অর্থনীতির এসব প্রশ্নের তারা উত্তর দিচ্ছেন কীভাবে? মানুষ তাদের কাছে প্রশ্ন পাঠাচ্ছেনই বা কোন আশায়?
রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লা, নোয়াখালি, খুলনা, বগুড়া, মোমেনশাহীসহ দেশের অধিকাংশ বড় শহর-বিভাগে বড় বড় অনেক মাদরাসা আছে। বড় বড় এসব মাদরাসার একেকটির ভেতর ঢাকায় অনেকগুলো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ‘বিলিন’ করে দেওয়া যাবে। এসবের অনেক মাদরাসায় ‘ফতোয়া বিভাগ’ আছে। ফতোয়া বিভাগগুলোতে যেসব বিষয় নিয়ে চর্চা করা হয়, তার একটি প্রধান বিষয় হল আধুনিক ও ইসলামী অর্থনীতি। দেশ-বিদেশের প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা সমাপনকারী যোগ্য আলেমগণ এসব মাদরাসায় ‘প্রধান মুফতি’ পদে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। যেকোনো ব্যক্তি এসব মাদরাসার ইফতা বিভাগে গেলে, মাদরাসায় অর্থনীতি পড়ানো হয় কিনা হাতে কলমে এ প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন। কষ্ট করে শুধু একটু মাদরাসার ‘অচ্ছুৎ’ আঙ্গিনায় পা রাখার দরকার।
বাংলাদেশের প্রধানসারির বেশ কয়েকটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় ‘ইসলাম পাতা’ আছে। এসব পাতায় নিয়মিত অর্থনীতি-ইসলামী অর্থনীতি নিয়ে কলাম, প্রবন্ধ, মাসয়ালা, গবেষণা প্রকাশিত হয়ে থাকে। লেখেন দেশের প্রথিতযশা আলেম ও গবেষক মুফতিবৃন্দ। সাংবাদিকতা জগতের মানুষ হওয়ার কারণে পত্রিকার বিষয়টি ইলিয়াস ভাইয়ের জানা থাকার কথা। তিনি কেন জানেন না, সেটা একটা বড় প্রশ্ন।
বোঝা গেল, ইলিয়াস ভাই একেবারেই না জেনে, অজ্ঞতাসুলভ বিদ্বেষ থেকে অভিযোগ চাপিয়ে দিয়েছেন পুরো কওমি সমাজের ওপর। তার ভিডিও মানুষ দেখে, ফলে ভিডিও দেখে অসংখ্য মানুষ বিভ্রান্ত হবেন। তারা মনে করবেন কওমি মাদরাসায় বোধহয় অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি, বিচার ব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে কিছুই পড়ানো হয় না। অথচ কওমি মাদরাসায় এসব বিষয় সর্বোচ্চ গুরুত্বের সাথে পড়ানো হয়, গবেষণা করা হয়। ইসলাম ও আধুনিক (পশ্চিমা) সব ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা-গবেষণা করানো হয়।
তিন.
ইলিয়াস ভাই তার টকশোতে ভয়ানক অশ্লীল, জঘন্য ও চরম আপত্তিকর ভাষা-ভঙ্গিতে যে আলেমের সম্মানহানি করেছেন, কাকতালীয়ভাবে সে আলেমই একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আধুনিক অর্থনীতিতে মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন। পরবর্তীতে তিনি সে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী অর্থনীতি ও আধুনিক অর্থনীতি বিষয়ে অধ্যাপনাও করেছেন!
তাহলে ইলিয়াস ভাই যাকে গালিগালাজ করলেন, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করলেন, অত্যন্ত বিদ্রুপের সাথে কওমি মাদরাসার শিক্ষাব্যবস্থাকে অকার্যকর করে দেখাতে চাইলেন, সে আলেমের অস্তিত্ব-যোগ্যতাই ইলিয়াস ভাইয়ের কথা মিথ্যা প্রমাণিত করল।
চার.
কওমি মাদরাসা, কওমি মাদরাসার যোগ্য ব্যক্তি, কওমি মাদরাসার সিলেবাস-পড়াশোনা, এসব বিষয়ে ইলিয়াস ভাই তেমন কোনো ধারণাই রাখেন না। ইলিয়াস হোসাইনের টকশো এটাই প্রমাণ করেছে। তিনিও ‘শুনে শুনে মুসলমান’। কারণ, তিনি তার টকশোতে যে তিনজন ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন; শুধু কারাবন্দী, জেল, জঙ্গীবাদ নিয়ে তাদের সাথে কথা বললে হয়ত ঠিক ছিল। কিন্তু তিনি বিষয়ের বাইরে গিয়ে কারো ব্যক্তি জীবনে আক্রমণ করেছেন, এমন বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করেছেন, যে সম্পর্কে টকশোতে উপস্থিত উক্ত তিনজন আসলে কথা বলার যোগ্যতা রাখেন না। আসিফ আদনান ভাই তো আলেমই নন। আব্দুল্লাহ বিন নুরুল ইসলাম সাহেব কোন স্তর বা পর্যায়ের যোগ্যতার মানুষ, আলেম কিনা জানা নেই। আর রফিকুল ইসলাম মাদানি অর্থনীতির বিষয় বোঝানোর মত যোগ্যতা রাখে কিনা জানা নেই। তবে টকশোতে প্রমাণিত হয়েছে, তারা এ বিষয়ে কথা বলার যোগ্যতা রাখেন না।
ফলে ইলিয়াস ভাই ৭১ টিভির ফারজানা রুপার মত, আর সময় টিভির হলুদ সাংবাদিকদের মত কাজ করেছেন। তিনি তার টকশোতে নিজের পসন্দ মত লোক ডেকে নিয়ে ইসলামের একাডেমিক ও কওমি মাদরাসার শাস্ত্রীয় বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করেছেন, যার যে সম্পর্কে বিলকুল ধারণা নেই, তাকে সে প্রশ্ন করেছেন। তিনি আলেম মানেই, দাড়ি টুপি মানেই যোগ্য মুফতি, বিশেষজ্ঞ আলেম মনে করেছেন! যেটা তার চিন্তার দৈন্যতা, কওমি সম্পর্কে জানাশোনার রিক্ততা প্রকাশ করেছে। এখানে তিনি জেনে হোক বা না জেনে ভয়াবহ অপরাধ করেছেন।
ইলিয়াস হোসাইনের পুরো টকশো দেখে মনে হয়েছে, তিনি চরম বিভ্রান্তির শিকার। কওমি শিক্ষা ও আলেম সমাজের ওপর এসব অবান্তর-অসত্য অভিযোগ আনেক আগে থেকেই একটি ‘ইসলামী’ দলের নেতাকর্মীরা ‘ইবাদত’ মনে করে উত্থাপন করে থাকেন। ইলিয়াস ভাই সম্ভবত তাদের ‘কানপড়ার’ শিকার হয়েছেন। আগ-পিছ না ভেবে, শিখিয়ে দেওয়া বুলি কপচানোর মত টকশোতে সেসব কথা ছেড়ে দিয়েছেন। ফলে তিনি আলেম সমাজ ও কওমি শিক্ষার প্রতি চরম বিদ্বেষ লালনকারী সাব্যস্ত হয়েছেন। আলেম সমাজের বিরুদ্ধে ওই ‘ইসলামী’ দলের এসব প্রোপাগাণ্ডা খুব পুরাতন, ইলিয়াস ভাইয়ের কাছে নতুন ও মুখরোচক লেগে থাকতে পারে। ওই ‘ইসলামী’ দলের নেতাকর্মীরা নিজেদের কুরআন-হাদিসের জ্ঞানশূন্যতা ঢাকতে তাদের জন্মের পর থেকেই উলামায়ে কেরামের প্রতি আক্রমণ ও বিদ্বেষ পোষণ করে চলেছে, হয়তো কেয়ামত পর্যন্ত করবে।
পাঁচ.
ওই টকশোতে যারা আলেম সমাজের প্রতিনিধি হয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন, তাদেরও হুঁশ-জ্ঞান থাকা উচিত ছিল, অজানা বিষয়ে কথা বলা অন্যায়। ফিকহি দৃষ্টিকোণে অজানা বিষয়ে কথা বলা নাজায়েজ। তারা সেই নাজায়েজ কাজই করেছেন।
এর আগেও আমরা বেশ কয়েকবার দেখেছি, বিভিন্ন টিভি টকশোতে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অযোগ্য, অপারদর্শী আলেমদের নিয়ে গিয়ে পুরো আলেম সমাজকে চরম অস্বস্তি ও বিপদে ফেলে দেওয়া হয়। চ্যানেলের পক্ষ থেকে দাওয়াত দিলেই আমাকে সেখানে যেতে হবে? আমি সে বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞান রাখি কিনা, ‘টকশো শাস্ত্রে’ আমার অভিজ্ঞতা আছে কিনা, সহআলোচক হিসেবে যিনি আসবেন, তার সম্পর্কে ধারণা আছে কিনা, এসব কি কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়?
কাদিয়ানি নেতা আব্দুল আওয়াল খান চৌধুরির সাথে জুলফিকার জহুর নামে একজন আলেমের টকশো, ইসলামবিদ্বেষী সারা হোসেনের সাথে জামায়াত নেতা খলিলুর রহমান মাদানির টকশো, ইলিয়াস ভাইয়ের টকশোর তিন ‘হুজুরের’ অবস্থা একই। নির্দিষ্ট বিষয়ে না জেনে ভুল কথা, অসত্য কথা বলে, বিপক্ষের অযৌক্তিক কথা মেনে নিয়ে এসব লোকজন নিজেরা পরাজিত ও হাসির পাত্র তো হনই, পাশাপাশি ইসলামকেও পরাজিত করে আসেন। এসব লোকের হুঁশ হওয়া জরুরি। কোনো না জানা বিষয়ে কথা বলা তো চরম মূর্খতা, ভয়াবহ জাহালাত। প্রসিদ্ধির লোভে, সেলিব্রিটিজমের ফাঁদে পড়ে কেন এসব সহজ বিষয় তারা বুঝতে পারেন না, সেটা বড় দুঃখের বিষয়। প্রত্যেক ফন-শাস্ত্রের অনেক যোগ্য আলেম আছেন। নির্দিষ্ট বিষয়ে সুন্দর করে, প্রতিপক্ষের গলি-ঘুপচি বোঝে, গুছিয়ে উত্তর দেওয়ার মত অনেক আলেম আছেন। তাদের কাছে প্রস্তাব গেলে কেন তারা যোগ্যদের সন্ধান দিতে পারেন না? নিজেরা যোগ্যদের সাহায্য নিয়ে কেন পূর্ণ প্রস্তুতি নেন না? চেহারা-ছবি, সাজুগুজু, পোশাকের বাহার আর সেলিব্রিটিজম দিয়ে তো শত্রুর সাথে জেতা যায় না। তাই না!