জুলাই মাসের অভ্যুত্থান-পূর্ব আন্দোলন দমনে তৎকালীন সরকারকে সহযোগিতা এবং গণহত্যায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা রাখার অভিযোগে আওয়ামীপন্থি ৩১ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। শহীদ মোহাম্মদ আদিলের বাবা মো. হারুন অর রশিদ এই মামলা দায়ের করেন।
ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) আদালত সোমবার (১১ আগস্ট) মামলাটি আমলে নিয়ে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)-কে তদন্তের নির্দেশ দেন। মামলাটি দায়ের করা হয়েছে দণ্ডবিধির ১২০খ (ষড়যন্ত্র), ১৪৩ (অবৈধ সমাবেশ), ২০৩ (ভুল তথ্য প্রদান), ৪৩১, ৪৪০, ৫০০-৫০২ (মানহানি), ৫০৪-৫০৫(ক) (উসকানিমূলক বক্তব্য) ও ৫০৬ (হুমকি) ধারায়।
অভিযোগের সারসংক্ষেপ
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ২০১৮ সাল থেকে আওয়ামী সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক জনঅসন্তোষ তৈরি হয়। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ নেয়। এই সময়ে কয়েকজন প্রভাবশালী সাংবাদিক তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আন্দোলন দমন, কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ এবং আন্তর্জাতিক চাপ মোকাবিলায় সহায়তা করেন।
অভিযোগ অনুযায়ী—
-
২৪ জুলাই ২০২৪ তারিখে গণভবনে একটি বৈঠকে অংশ নিয়ে তারা প্রধানমন্ত্রীকে আন্দোলন মোকাবিলায় ‘যে কোনো মূল্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবহার’ করার পরামর্শ দেন।
-
২৭ জুলাই জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে এক সমাবেশে তারা আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বক্তব্য রাখেন, যেখানে আন্দোলনকারীদের বিদেশি এজেন্ট, রাষ্ট্রদ্রোহী এবং ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে চিত্রিত করা হয়।
-
তাদের মাধ্যমে প্রচারিত বক্তব্য ও সংবাদে সরকারবিরোধী আন্দোলনের বিরুদ্ধে জনমত তৈরির চেষ্টা হয়, যা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগে উৎসাহ জোগায়।
মামলায় অভিযুক্তদের নাম
শেখ হাসিনার সাবেক তথ্য উপদেষ্টা ও ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাংবাদিক ফোরাম’-এর সভাপতি ইকবাল সোবহান চৌধুরী, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ, জাতীয় প্রেস ক্লাবের তৎকালীন সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিন, বিএফইউজের সাবেক সভাপতি ওমর ফারুক, একুশে টেলিভিশনের সাবেক প্রধান নির্বাহী মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল, জাতীয় প্রেস ক্লাবের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শ্যামল দত্ত, বিএফইউজের সাবেক মহাসচিব (আওয়ামীপন্থি) আব্দুল জলিল ভূঁইয়া, সাংবাদিক নেতা আজিজুল ইসলাম ভূঁইয়া, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) তৎকালীন সভাপতি সোহেল হায়দার চৌধুরী, সম্পাদক ফোরামের তৎকালীন আহ্বায়ক রফিকুল ইসলাম রতন, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির তৎকালীন সভাপতি সৈয়দ শুকুর আলী শুভ, ডিইউজের (আওয়ামীপন্থি) তৎকালীন সিনিয়র সহ-সভাপতি নজরুল ইসলাম মিঠু, বঙ্গবন্ধু সাংবাদিক পরিষদের তৎকালীন সদস্যসচিব মোহাম্মদ আবু সাঈদ, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (আওয়ামীপন্থি) তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আকতার হোসেন, বিএফইউজের তৎকালীন মহাসচিব ও নাগরিক টিভির হেড অব নিউজ দীপ আজাদ, ডিবিসি নিউজের সম্পাদক জায়েদুল আহসান পিন্টু, বাংলাদেশ প্রতিদিনের সাবেক সম্পাদক নঈম নিজাম, ডিবিসি নিউজের এডিটর ইন চিফ ও সিইও মঞ্জুরুল ইসলাম, কালবেলার সাবেক সম্পাদক আবেদ খান, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রেস সচিব নাইমুল ইসলাম খান, এডিটরস গিল্ডের সাবেক সভাপতি ও একাত্তর টিভির সাবেক সিইও মোজাম্মেল বাবু, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম, গ্লোবাল টিভির নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ ইসতিয়াক রেজা, আমাদের সময়ের নির্বাহী সম্পাদক মাঈনুল আলম, বাংলাদেশ জার্নালের সম্পাদক শাহজাহান, ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভির হেড অব নিউজ আশিষ সৈকত, বাংলা ট্রিবিউনের সম্পাদক জুলফিকার রাসেল, একাত্তর টিভির হেড অব নিউজ শাকিল আহমেদ, কিংস নিউজের হেড অব নিউজ নাজমুল হক সৈকত, এবং আর টিভির হেড অব নিউজ মামুনুর রহমান খান।
শহীদ মোহাম্মদ আদিলের প্রেক্ষাপট
মোহাম্মদ আদিল ছিলেন ঢাকার একটি বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র। ১৯ জুলাই ২০২৪ তারিখে সাইনবোর্ড-যাত্রাবাড়ী এলাকায় আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলিতে তিনি নিহত হন। তার পরিবার অভিযোগ করে, সরকারপন্থি সাংবাদিকদের প্রচারণা আন্দোলনকারীদের দমনকে ন্যায্যতা দেয়, যার ফলশ্রুতিতে এই হত্যাকাণ্ড ঘটে।
তদন্ত ও পরবর্তী পদক্ষেপ
আদালত পিবিআইকে দ্রুত তদন্ত সম্পন্ন করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছে। মামলার বাদী হারুন অর রশিদ বলেন, “যারা কলম ও ক্যামেরা দিয়ে গণহত্যার পক্ষ নিয়েছে, তারা ন্যায়বিচারের আওতায় আসুক—এটাই আমার চাওয়া।”
সরকারপন্থি সাংবাদিক নেতাদের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তবে তাদের ঘনিষ্ঠ সূত্র বলছে, অভিযোগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
হাআমা/