বাংলাদেশের পর এবার ভারতেও শেখ মুজিবের ভাস্কর্য নিয়ে অসন্তোষ বাড়ছে। এই বিরোধ এমন একটি সময়ে সামনে এসেছে যখন আগামী ২৮ জানুয়ারি থেকে কলকাতায় আন্তর্জাতিক বইমেলা শুরু হবে। তবে মেলায় বাংলাদেশের কোনো বই থাকবে না বলে জানিয়েছেন আয়োজকরা।
কলকাতার প্রগতিশীল সমাজের একটি অংশ বলছে, বাংলাদেশের প্রকাশকরা আমাদের বইমেলায় আসতে পারছে না। আমরাও একুশের বইমেলায় অংশ নিতে পারি না। তাহলে মুজিবুরের মূর্তি কলকাতায় থাকবে কেন?
সংশ্লিষ্টদের দাবি, ‘শেখ মুজিব কলকাতার জন্য কোনো অবদান রাখেননি। তার চেয়ে অনেক বেশি অবদান রয়েছে, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, একে ফজলুল হকের। কিন্তু তাদের তো বড় বড় স্ট্যাচু হয়নি।’
গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে বাংলাদেশের স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পতন ঘটে। সেদিন দুপুরেই তিনি দিল্লি পালিয়ে যান। জুলাই বিপ্লবের পর শেখ মুজিবের ভাস্কর্য ভাঙচুর শুরু হয় বাংলাদেশে। দেশের যত্রতত্র তিনি মূর্তি স্থাপন করেছিলেন সরকারি কোষাগারের টাকায়। এতে চার হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে বলে সরকারি তথ্যে উঠে এসেছে। হাসিনা শুধু নিজের দেশেই বাবার মূর্তি স্থাপন করে ক্ষান্ত হননি, ভারতের মাটিতেও তিনি মুজিবের ভাস্কর্য তৈরির জন্য নানা উদ্যোগ নেন। সেই অনুযায়ী, কলকাতার ঐতিহ্যবাহী বেকার হোস্টেল ও শিয়ালদহ স্টেশন চত্বরে তৈরি হয়েছে মুজিবের মূর্তি।
শিয়ালদহ কোর্টের সামনের রাস্তা পার হলেই দেখা মিলবে মহাত্মা গান্ধী ও শেখ মুজিবের বিশাল মূর্তি। উপরে লেখা ‘ফাদার অব নেশন, ইন্ডিয়া বাংলাদেশ’। ‘নয়া ভারত’ নামের একটি ডানপন্থী সংগঠনের নেতা সুদর্শন নায়েক জানাচ্ছেন, ‘উনি এখানে কেন? উনি কি আমাদের জাতির পিতা?’ ফেসবুকে একজন আবার এটাকে ‘ভারতের লজ্জা’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। জনৈক শান্তনু সিং বলছেন, ‘আমাদের কি দুজন ফাদার অব নেশন রয়েছে?’
যদিও অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মুজিবকে জাতির জনক হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে না। উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, ‘মুজিবকে আমরা জাতির পিতা মানি না। কে কী ঠিক করে দিয়েছে বা বলেছে— তা আমরা কেন মেনে চলব।’
এখন খোদ কলকাতাতেই প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশই যখন তাকে জাতির পিতা মানে না, তখন কলকাতায় তার মূর্তি রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন কেন?’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিপিআইএমএলের এক উচ্চপদস্থ নেতা জানান, ‘মুজিব কেমন মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন আমরা সেই ইতিহাস জানি। তাই তার মূর্তি থাকল না ধুলোয় ঢাকা পড়ল, নাকি কেউ ভেঙে গুঁড়িয়ে দিল— তাতে আমাদের যায় আসে না।
জানা যায়, শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৫-৪৬ সালে মাওলানা আজাদ কলেজে পড়ার সময় মধ্য কলকাতার বেকার হোস্টেলের ২৪ নম্বর ঘরের আবাসিক ছাত্র ছিলেন। ১৯৯৮ সালে ২৩ ও ২৪ নম্বর রুমকে একত্র করে পশ্চিমবঙ্গ সরকার শেখ মুজিবুর রহমানের সম্মানে ‘বঙ্গবন্ধু স্মৃতিকক্ষ’ তৈরি করে। ২০১১ সালে সেখানেই তার বুক সমান মুর্তি স্থাপন করা হয়। তারপর থেকে এটা নিয়ে চলছে বিতর্ক। কেননা এই হোস্টেলে মুসলিম ছেলেরাই থাকেন। বেকারের প্রাঙ্গণে রয়েছে সুদৃশ্য বড় মসজিদ, যেখানে পাঁচ ওয়াক্ত ও জুমার নামাজ হয়। এমন একটি জায়গায় মুজিবুরের মূর্তি স্থাপন নিয়ে শুরু থেকেই আপত্তি ছিল শিক্ষার্থীদের।
এর আগে মূর্তিটিকে অনৈতিক ও ইসলামবিরোধী অভিহিত করে বিরোধিতায় সরব হয় অল বেঙ্গল মাইনোরিটি ইয়ুথ ফেডারেশন। দলটি বলেছে, হোস্টেলটি মুসলিম ছাত্রদের জন্য এবং যেহেতু এটির প্রাঙ্গণে একটি মসজিদ রয়েছে, এই পরিবেশে এ ধরনের মূর্তি অনুমোদন করা যায় না।
অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের সদস্য মো. কামরুজ্জামান বলেন, ‘কোনো মুসলিম প্রতিষ্ঠানের ভেতরে মূর্তি নেই। আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি স্যার সৈয়দ আহমেদ খান গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে কখনোই তার মূর্তি স্থাপন করা হয়নি।’
আরেক প্রভাবশালী সংগঠন জমিয়তে আহলে হাদিসের সভাপতি হাফিজ শেখ নসরুল বারি বলেন, ‘মসজিদ প্রাঙ্গণে এ ধরনের মূর্তি ইসলাম ধর্ম সমর্থন করে না। আমরা অন্তর দিয়ে ঘৃণা করি। তবে এখন এটা নিয়ে প্রতিবাদ করলেই বাংলাদেশপন্থী বলে তকমা দেবে। এ জন্যই আমরা রাস্তায় নামছি না।’
এমএনএকে/