স্টাফ রিপোর্টার>>
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় মাদরাসাগুলোর ভূমিকা অপরিসীম। বিশেষত ধর্মীয় শিক্ষার ক্ষেত্রে কওমি মাদরাসাগুলির ঐতিহ্য ও প্রভাব রয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকার মিরপুর-১১ বাসস্ট্যান্ডে অবস্থিত জামিয়া মুহাম্মাদিয়া আরাবিয়া মাদরাসার ১৭ জন শিক্ষককে সম্পূর্ণ বিনা নোটিশে বহিষ্কারের ঘটনা নানা বিতর্ক ও সমালোচনা সৃষ্টি করেছে। জনসাধারণের মাঝে কওমি মাদরাসার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে।
ভুক্তভোগী শিক্ষকগণ অভিযোগ করেছেন, তাদের চাকরিচ্যুতির কারণ সুস্পষ্ট নয়, এটি রাজনৈতিক ও অন্যায়ভাবে করা হয়েছে। নতুন কমিটি ও মুহতামিমের প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন তারা। প্রতিষ্ঠান থেকে হঠাৎ ১৭ জন শিক্ষক বহিষ্কার কোনো সাধারণ ঘটনা নয়। ১৭ জনের ভেতর মেহনতি, যোগ্য ও দীর্ঘদিনের শিক্ষক রয়েছেন। জুলুমের চূড়ান্ত প্রয়োগ করা হয়েছে এ ঘটনায়। তারা এ ঘটনার বিচার চান, চাকরি ফেরত চান।
এ পরিস্থিতিতে কওমি মাদরাসার সর্বোচ্চ অথরিটি আল-হাইআতুল উলয়া লিল-জামিআতিল কওমিয়া ও কওমি মাদরাসার সবচেয়ে বড় বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ (বেফাক) এর সহ-সভাপতি ও অন্যান্য দায়িত্বশীলরা এই ঘটনায় তাদের ভূমিকা এবং পদক্ষেপের বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন।
পড়ুন… একযোগে ১৭ শিক্ষককে বহিষ্কার, কী ঘটছে মিরপুর জামিয়া মুহাম্মাদিয়ায়!
মাদরাসাটির নতুন কমিটি ও মুহতামিম বলছেন, প্রতিষ্ঠানের উন্নতির জন্য এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে বেফাকের দায়িত্বশীলগণ লিখিত অভিযোগ পাওয়ার পর তদন্তের মাধ্যমে বিষয়টি সমাধান করার আশ্বাস দিয়েছেন। এসব বিষয়ে বেফাকের একাধিক দায়িত্বশীল ও মাদরাসার নতুন মুহতামিমের সঙ্গে কথা বলেছে ৩৬নিউজ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বোর্ডের সহ-সভাপতি ও মিরপুর আরজাবাদ মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা বাহাউদ্দীন যাকারিয়া বলেন, ‘আমরা এখনো কোনো অফিশিয়াল তথ্য পাইনি। মুখে মুখে শুনেছি। লিখিত অভিযোগ আসলে তদন্তের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
তিনি আরও জানান, ‘পূর্বে যারা লিখিত অভিযোগ করেছেন, তাদের বিষয়ে বেফাক যথাযথ ভূমিকা নিয়েছে। বেফাক এ ধরনের সমস্যার সমাধান করেছে এবং মিরপুর মুহাম্মাদিয়া মাদরাসার সমস্যা সমাধানেও পদক্ষেপ নেবে।’
ভুক্তভোগী শিক্ষকরা লিখিত অভিযোগ করলে বেফাক কোন ধরনের পদক্ষেপ নেবে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আবেদন করলে বেফাকে মিটিংয়ের পর তদন্ত টিম করে, উভয় পক্ষের সাথে কথা বলে করণীয় নির্ধারণ করবে।’
‘মাদরাসা-মসজিদের কমিটিতে ধর্মজ্ঞানহীন রাজনৈতিক দলের লোক থাকা ও উলামায়ে কেরামের অংশগ্রহণ না থাকার ফলে এমন সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
ভুক্তভোগী শিক্ষকদের বিষয়ে বেফাক এগিয়ে আসবে কিনা জানতে চাইলে বোর্ডের সহ-সভাপতি মাওলানা মুসলেহ উদ্দীন রাজু বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে কেউ লিখিত অভিযোগ করেনি। যদি কেউ লিখিত অভিযোগ করেন, তবে বেফাক তদন্ত করে পদক্ষেপ নেবে। কওমি মাদরাসার শিক্ষকদের যেকোনো অসুবিধা সমাধানে বেফাক আন্তরিক।’
‘মাদরাসা-মসজিদের পরিচালনা সুচারু করতে বেফাক কাজ করে যাচ্ছে।’- আরও যোগ করেন তিনি।
একযোগে ১৭ জন শিক্ষক বহিষ্কারের বিষয়ে জানতে চাইলে বেফাকের সিনিয়র দায়িত্বশীল মাওলানা নেয়াতুল্লাহ ফরিদী বলেন, ‘এ বিষয়টি আমাদের জানা ছিল না। কেউ লিখিত অভিযোগ করলে তদন্ত কমিটি গঠন করে সমাধানের চেষ্টা করবে বোর্ড।’
বেফাকভুক্ত কোনো মাদরাসার শিক্ষক জুলুমের শিকার হলে তার জন্য বেফাক কোনো ব্যবস্থা নেবে কিনা- এমন প্রশ্ন করলে তিনি জানান, ‘কেউ জুলুমের শিকার হলে অবশ্যই তাদের জন্য বেফাক প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।’
তিনি আরও জানান, ‘মাদরাসাগুলোর নিয়োগ-অব্যহতি সাধারণত নিজস্ব সিদ্ধান্তে হয়ে থাকে এবং সেখানে বেফাকের কোনো পরামর্শ বা হস্তক্ষেপ থাকে না। তবে, কেউ জুলুমের শিকার হলে বেফাকের মাধ্যমে সমাধান চাওয়া যেতে পারে।’
শিক্ষকদের বহিষ্কারের পেছনে আপনার কোনো অন্যায় হস্তক্ষেপ আছে কি না- ৩৬নিউজের পক্ষ থেকে এমন প্রশ্নের উত্তরে মাদরাসার বর্তমান মুহতামিম মাওলানা আব্দুল বাতেন কাসেমী বলেন, ‘বর্তমানে প্রতিষ্ঠানের পরিচালনার দায়িত্বে আমি আছি। প্রতিষ্ঠানের উন্নতির জন্য কিছু কাজ করতে হচ্ছে। কোনো ব্যক্তির ওপর রাগ করে কিছু্ই হচ্ছে না এখানে। অব্যহতিপ্রাপ্ত শিক্ষকদের যেহেতু খেদমতের প্রয়োজন, সে হিসেবে রমজানের শুরুতে আমরা তাদের জানিয়ে দিয়েছি। যাতে তারা কোথাও খেদমত ঠিক করতে পারেন। এর সাথে তাদের এক মাসের বেতন ও ঈদ বোনাস দেওয়ার সিদ্ধান্তু নেওয়া হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এ প্রতিষ্ঠানে যোগ্য-কর্মঠ শিক্ষক থাকলে প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠান হতো।’
কোনো নোটিশ ছাড়া হঠাৎ একসঙ্গে ১৭ শিক্ষক বহিষ্কার দেশের কোন আইনে করা হয়েছে- এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যেহেতু এ প্রতিষ্ঠানটি সরকারি নয়, কমিটি পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কমিটি যে সিদ্ধান্তু নেন সেটাই কার্যকর করেন।’
বেফাক-হাইয়ার জাতীয় মেধা তালিকায় স্থান পাওয়া, দারুল উলুম দেওবন্দ ও দেশের গ্রহণযোগ্য প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাগ্রহণকারী শিক্ষকরা কীভাবে অযোগ্য হন, এমন প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি মাওলানা আব্দুল বাতেন কাসেমী।
এদিকে এখনো এই ঘটনায় মাদরাসার ভেতর-বাইরে তোলপাড় চলছে। বহিষ্কারের ঘটনা দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। মাদরাসার নতুন কমিটি ও নতুন মুহতামিম ইমেজ সংকটে পড়েছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনা তুঙ্গে রয়েছে। বেফাক কর্তৃপক্ষ তদন্তের আশ্বাস দিয়েছেন। শিক্ষকদের অভিযোগের সুষ্ঠু সমাধান এবং আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। মাদরাসা পরিচালনা ও শিক্ষক নিয়োগ-অব্যহতি প্রক্রিয়া আরও স্বচ্ছ করার প্রয়োজনীয়তার কথাও বলছেন অনেক বিশেষজ্ঞ।
এআইএল/