সম্প্রতি নারী সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে সরকারের নিকট যে প্রতিবেদন ও সুপারিশমালা জমা দেওয়া হয়েছে, তা কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী, নীতি-আদর্শ বিবর্জিত এবং সমাজ ও পরিবার-বিধ্বংসী। এ প্রতিবেদন নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে অনতিবিলম্বে এই প্রতিবেদন প্রত্যাহার এবং বিতর্কিত কমিশন বাতিল করে সমাজের ধর্মীয় অনুশাসন ও মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে নারী-পুরুষের ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সংস্কারের পদক্ষেপ গ্রহণ করার আহবান জানিয়েছে দাওয়াতি সংগঠন ‘পয়ামে ইনসানিয়াত বাংলাদেশ’।
গতকাল বুধবার (৩০ এপ্রিল) বিকাল ৩টায় বাংলাদেশ শিশু কল্যাণ পরিষদে মুফাক্কিরে ইসলাম সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ. প্রতিষ্ঠিত দাওয়াতি সংগঠন ‘পয়ামে ইনসানিয়াত বাংলাদেশ’ আয়োজিত ‘নারী স্বাধীনতার দাবির আড়ালে পরিবার ব্যবস্থা ধ্বংসের ষড়যন্ত্র’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে এ আহ্বান জানানো হয়।
সংগঠনের আমির ড. মাওলানা শহীদুল ইসলাম ফারুকীর সভাপতিত্বে এবং মুফতি আফজাল হুসাইনের সঞ্চালনায় গোলটেবিল বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন খেলাফত মজলিসের নায়েবে আমির মাওলানা আহমদ আলী কাসেমী, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল এডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের অধ্যাপক ড. একেএম মুহিব্বুল্লাহ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব ড. মুফতি শুয়াইব আহমদ, খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব মুহাম্মদ মুনতাসির আলী, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব মুফতি শরাফত হুসাইন ও মাওলানা তাফাজ্জুল হোসেন মিয়াজি, মুহাম্মদ আব্দুল আহাদ নূর, মুফতি আব্দুল্লাহ ইয়াহইয়া, মাওলানা রুহুল আমীন সাদী, মুফতি শাঈখ মুহাম্মাদ উসমান গণি, মুফতি ইমরানুল বারী সিরাজী, এনসিপি’র সংগঠক মাওলানা সানাউল্লাহ খান, হাকীম মাওলানা আজহারুল ইসলাম নোমানী, ড. ঈসা মুহাম্মদ, মুফতি আব্দুল্লাহ নাটোরী, মুফতি ওমর ফারুক যুক্তিবাদী, অধ্যাপক মাওলানা মহব্বত হুসাইন, মুফতি আব্দুল গাফফার, মুফতি কামরুল হাসান নেছারী প্রমুখগণ।
কমিশনের সুপারিশসমূহের মধ্যে বিশেষভাবে যেগুলো জনমনে গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে, তা হলো-
০১. মুসলিম উত্তরাধিকার আইন বাতিল করে নারী-পুরুষকে সমান সম্পত্তি প্রদানের প্রস্তাব করা হয়েছে। যা ইসলামী শরীয়াহ ও সংবিধানে সংরক্ষিত ধর্মীয় স্বাধীনতার স্পষ্ট লঙ্ঘন।
০২. অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রবর্তনের সুপারিশের মাধ্যমে সব ধর্মের নারীদের জন্য বিয়ে, তালাক ও উত্তরাধিকারে একক রীতি চালু করতে বলা হয়েছে। এটি ধর্মীয় আইন ও সংস্কৃতির প্রতি সরাসরি অবজ্ঞা এবং এক ধরনের আইনগত ‘ধর্মত্যাগ’ চাপিয়ে দেওয়ার পাঁয়তারা।
০৩. ইসলামী পারিবারিক আইনকে বৈষম্যমূলক আখ্যা দিয়ে তা বাতিলের প্রস্তাব করা হয়েছে। যা সরাসরি মানুষের ধর্ম পালনে বাধা প্রদান ও ধর্ম অবমাননার শামিল।
০৪. বিবাহ ও পারিবারিক ব্যবস্থায় জাতিসংঘ প্রণীত নীতি বাস্তবায়নের প্রস্তাব করা হয়েছে। যা মূলত ইসলামি বিধানকে অগ্রাহ্য করে পশ্চিমা প্রকৃতিবিরোধী নারীবাদী নীতি চাপিয়ে দেওয়ার সুগভীর ষড়যন্ত্র।
০৫. নারী-পুরুষের সম্পর্ককে ‘ক্ষমতার দ্বন্দ্ব’ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। এটি বাঙালি সমাজে প্রচলিত পারস্পরিক সহমর্মিতা, মমতা ও সহযোগিতার সম্পর্ককে ধ্বংস করে দেয়ার মত বিপজ্জনক চিন্তা।
০৬. পতিতাবৃত্তিকে বৈধতা দিয়ে যৌনকর্মীদের ‘শ্রমজীবী’ হিসেবে স্বীকৃতি ও মর্যাদা প্রদানের সুপারিশ করা হয়েছে। এটি সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়ের একটি ভয়ংকর ব্যবস্থা। ইসলাম ও সুস্থ সমাজব্যবস্থা পতিতাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে মানে না; বরং তা নির্মূল করে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করাই রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
আমাদের পর্যবেক্ষণ ও অবস্থান :
০১. আমাদের পর্যবেক্ষণ হলো-এই কমিশনের সদস্যরা একটি বিশেষ মতাদর্শের প্রতিনিধিত্ব করেন, যারা দেশের ধর্মপ্রাণ নারীদের মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করেন না। এই কমিশন কোনোভাবেই বাংলাদেশের নারীদের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর প্রতিচ্ছবি নয়।
০২. এই প্রতিবেদন গবেষণাধর্মী নয়, একপেশে মতাদর্শিক বক্তব্য। তাতে সমাজবিজ্ঞানের মৌলিক পদ্ধতিও অনুসরণ করা হয়নি। তথ্যবিহীন এই নীতিমালা আসলে একটি মতাদর্শিক প্রোপাগান্ডা মাত্র।
০৩. নারী উন্নয়নের নামে ধর্মীয় বিধানকে বাতিল করার যে অপচেষ্টা করা হচ্ছে তা কেবল ইসলাম নয়, সকল ধর্মের প্রতি অবমাননার শামিল এবং দেশে সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করবে।
০৪. এই সুপারিশমালা বাস্তবায়িত হলে আবহমানকাল ধরে চলে পারিবারিক ব্যবস্থা ও বন্ধন ভেঙ্গে পড়বে এবং সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হবে।
আমাদের দাবি :
০১. নারী সংস্কার কমিশনের কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী সুপারিশ ও প্রতিবেদন অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে।
০২. ধর্ম, সংস্কৃতি ও জনমতকে অবজ্ঞা করে গঠিত বর্তমান কমিশন বাতিল করে ধর্মীয় ও সামাজিক বাস্তবতায় বিশ্বাসী প্রতিনিধিদের নিয়ে নতুন কমিশন গঠন করতে হবে।
০৩. পতিতাবৃত্তি নির্মূলের কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে এবং সংশ্লিষ্ট নারীদের মানবিক ও হালাল উপায়ে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।
০৪. ধর্মীয় বিধানসমূহকে সংবিধানের আলোকে রক্ষা করে নারী উন্নয়নের একটি ভারসাম্যমূলক ও সমাজবান্ধব রূপরেখা প্রণয়ন করতে হবে।
০৫. নারীর মর্যাদা ও অধিকার কুরআন-সুন্নাহর ভিত্তিতে বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
উক্ত গোলটেবিল বৈঠকে বক্তাগণ বলেন, ‘নারী সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে সরকারের নিকট যে প্রতিবেদন ও সুপারিশমালা জমা দেওয়া হয়েছে, তা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাস, পারিবারিক মূল্যবোধ এবং ঐতিহ্যের ওপর সরাসরি আঘাত হানে। এটি নারী উন্নয়নের নামে একটি মতাদর্শিক ও পশ্চিমাদের অনুকরণভিত্তিক আগ্রাসন ছাড়া কিছুই নয়।’
বক্তাগণ আরো বলেন, ‘দুঃখজনক ব্যাপার হলো এ সংস্কার প্রস্তাবে জনগণের ধর্মীয় মূল্যবোধের মোটেও তোয়াক্কা করা হয়নি। এসব সুপারিশ শুধু কুরআন ও সুন্নাহ’র সঙ্গেই সাংঘর্ষিক নয়, বরং ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সংবিধানেরও বিরোধী। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ধর্মীয় মূল্যবোধের বিরোধিতার নাম সংস্কার নয়। রাষ্ট্রীয় এমন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে অবশ্যই দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মূল্যবোধকে আমলে নিতে হবে।’
বক্তাগণ আরো বলেন, ‘নারীর প্রকৃত মুক্তি ও মর্যাদা ইসলামের মধ্যেই নিহিত। অথচ আজ তথাকথিত ‘নারী উন্নয়নের’ নামে ইসলামের দিকনির্দেশনা ও পরিবার-ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার অপচেষ্টা চলছে। উত্তরাধিকার আইন, বিবাহ-তালাকের বিধান, পর্দা ও অভিভাবকত্বের মতো বিষয়কে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে ইসলামকে ভুল ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে। সংস্কার প্রতিবেদনে নারী সমাজের তথাকথিত স্বাধীনতার নামে ধর্মীয় ও পারিবারিক মূল্যবোধকে উপেক্ষা করে এক ধরনের পশ্চিমা অনুকরণবাদকে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।’
সভাপতির বক্তব্যে পয়ামে ইনসানিয়াত বাংলাদেশের আমির ড. মাওলানা শহীদুল ইসলাম ফারুকী বলেন, ‘এই দেশ ইসলামপ্রিয় মানুষের দেশ। ধর্মহীন মতবাদ এবং পশ্চিমা সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণে নারী উন্নয়নের নামে যদি ইসলামবিরোধী ও সমাজবিধ্বংসী কোনো ব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়, তবে দেশের লাখো-কোটি মুসলমান এর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়াবে। আমরা সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে বলতে চাই, যদি এই প্রতিবেদন প্রত্যাহার ও কমিশন বাতিলের কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ না করা হয়, তবে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন একটি গণবিরোধী অবস্থানের দায় সরকারকেই বহন করতে হবে।’
এআইএল/