হাসান আল মাহমুদ >>
২০১৩ সালের ৫ মে রাত, বাংলাদেশের ইতিহাসে এক বেদনাবিধূর ও বিভীষিকাময় অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। রাজধানীর শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের ডাকে শান্তিপূর্ণ সমাবেশে অংশ নেওয়া হাজারো আলেম-ওলামা, মাদরাসা ছাত্র ও সাধারণ তাওহিদি জনতার ওপর গভীর রাতে বিদ্যুৎ বন্ধ করে রাষ্ট্রীয় বাহিনী ও সরকার-সমর্থিত সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে চালানো হয় সামরিক কায়দার দমন-পীড়ন। এই ঘটনার এক যুগ পেরিয়ে গেলেও আজও হয়নি কোনো নিরপেক্ষ তদন্ত, হয়নি কোনো বিচার। দীর্ঘ এক যুগ পেরিয়ে গেলেও এই ঘটনার বিচার হয়নি, বরং বারবার তথ্য গোপনের অভিযোগ উঠেছে। এই ঘটনার প্রতিবাদে ও বিচারের দাবিতে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ছাত্র সংগঠন প্রতিবছর নানা কর্মসূচির মাধ্যমে তাদের ক্ষোভ ও দাবি তুলে ধরে। ২০২৫ সালের ৫ মে-ও তার ব্যতিক্রম ছিল না। সারাদেশজুড়ে ছাত্র ও যুব সংগঠনগুলো বিক্ষোভ মিছিল, মানবপ্রাচীর, প্রতিবাদ সভা এবং বিবৃতির মাধ্যমে শাপলা ট্রাজেডি ও পরবর্তী জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার এবং আওয়ামী লীগের ‘সন্ত্রাসী’ কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সংগঠনটি নিষিদ্ধের জোরালো দাবি তোলে।
বাংলাদেশ খেলাফত যুব ও ছাত্র মজলিসের বিক্ষোভ : ‘শাপলা-জুলাই গণহত্যার বিচার এবং সন্ত্রাসী সংগঠন আওয়ামীলীগ নিষিদ্ধের দাবি’
শাপলা ও জুলাই গণহত্যার বিচার ও আওয়ামীলীগ নিষিদ্ধের দাবীতে সারা দেশে বিক্ষোভ মিছিল পালন করেছে বাংলাদেশ খেলাফত ছাত্র ও যুব মজলিস। এসব বিক্ষোভ সমাবেশে শাপলা ও জুলাই গণহত্যার বিচার এবং সন্ত্রাসী সংগঠন আওয়ামীলীগ নিষিদ্ধের দাবি জানানো হয়েছে।

শাপলা চত্বরে বাংলাদেশ খেলাফত যুব মজলিসের নেতৃবৃন্দ
বাংলাদেশ খেলাফত যুব মজলিস ও ছাত্র মজলিস কেন্দ্রঘোষিত কর্মসূচির অংশ হিসেবে সারা দেশে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ করে।
নারায়ণগঞ্জ মহানগরীতে বাদ আছর উকিলপাড়া মসজিদ থেকে মিছিল বের হয়, যেখানে সভাপতিত্ব করেন মহানগর সভাপতি মাওলানা ফাতীহ মুহাম্মাদ সোলাইমান এবং সঞ্চালনায় ছিলেন হাফেজ রিয়াদ হাসান।
প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন খেলাফত মজলিসের সিনিয়র সহ-সভাপতি মাওলানা আবু সাঈদ। বিশেষ অতিথি ছিলেন মাওলানা মীর আহমাদুল্লাহ, ডা. আল-আমীন রাকিবসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।
নোয়াখালী জেলার চৌমুহনীতে জেলা শাখার উদ্যোগে বিশাল মিছিল ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সভাপতিত্ব করেন জেলা সভাপতি মাওলানা হাবিবুর রহমান এবং বক্তব্য রাখেন খেলাফত মজলিস ও যুব মজলিসের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতারা। সকল বক্তার একমত— শাপলা ও জুলাই গণহত্যার বিচার না হওয়া দেশের গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচারের জন্য হুমকিস্বরূপ।
বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের মানবপ্রাচীর কর্মসূচি ; রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘শাপলা গণহত্যা দিবস’ ঘোষণা করতে হবে : শিবির সভাপতি

মতিঝিলে শাপলা চত্বরে শিবিরের মানবপ্রাচীর
মতিঝিল শাপলা চত্বরে ‘শাপলা গণহত্যা দিবস’ ঘোষণা, শহীদদের তালিকা প্রস্তুত এবং দোষীদের বিচার দাবিতে মানবপ্রাচীর গঠন করে ইসলামী ছাত্রশিবির। এছাড়া, সারাদেশে সংগঠনটি বিক্ষোভ প্রদশর্ণ করে।
সভাপতি জাহিদুল ইসলাম বলেন, “শাপলার গণহত্যা ২৫ মার্চের রাতকেও হার মানিয়েছে।” তিনি আরো বলেন, “এই বর্বরতার বিচার ছাড়া ফ্যাসিবাদ রোধ অসম্ভব।”
উক্ত কর্মসূচিতে শিবিরের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দসহ ঢাকা মহানগরের নেতারাও অংশগ্রহণ করেন।
৫ মে আহত-নিহতদের পরিবারকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের দাবি রাজু ভাস্কর্যে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যে ‘স্টুডেন্ট এলায়েন্স অফ ডিইউ’ আয়োজিত সমাবেশে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতারা অংশগ্রহণ করেন।
ড. আরিফুর রহমান অপু বলেন, “শাপলার ঘটনা ছিল রাজনৈতিক সন্ত্রাসবাদের সূচনা।”
তিনি এবং অন্যান্য বক্তারা দাবি জানান, শহীদ পরিবারকে ক্ষতিপূরণ, আহতদের ‘শাপলার বীর’ হিসেবে স্বীকৃতি এবং ৫ মে-কে শহীদ দিবস ঘোষণার।
ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের বিবৃতি: বিচারহীনতার সংস্কৃতি নিয়ে উদ্বেগ
ইসলামী ছাত্র আন্দোলন কেন্দ্রীয়ভাবে বিবৃতি দিয়ে জানায়, “নিরীহ জনতার ওপর এমন নির্মম গণহত্যার পরেও আজ অবধি কোনো স্বচ্ছ তদন্ত হয়নি।”
নেতৃদ্বয় দাবি জানান— দোষীদের বিচার, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী শহীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ এবং ‘শাপলা গণহত্যা দিবস’ রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন নিশ্চিত করা হোক।
৫ মে শাপলা চত্বরে গণহত্যার বিচার নিশ্চিত করতে হবে : ছাত্র জমিয়ত বাংলাদেশ
২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের ডাকে মতিঝিল শাপলা চত্বরে লক্ষাধিক নবীপ্রেমিক মুসলমান ১৩ দফা দাবিতে জমায়েত হন। সারাদিন কর্মসূচি পালন শেষে রাতের বেলায় তারা ইবাদত ও বিশ্রামে ছিলেন। অথচ তৎকালীন সরকার, আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের সন্ত্রাসীরা অতর্কিত হামলা চালিয়ে বহু নিরীহ আলেম ও মুসল্লিকে হত্যা করে এক ভয়াবহ ইতিহাসের জন্ম দেয়।
এই ঘটনার ১২ বছর পূর্তিতে, সোমবার গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে ছাত্র জমিয়ত বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সভাপতি রিদওয়ান মাযহারী ও সাধারণ সম্পাদক কাউসার বলেন—শাপলার হত্যাযজ্ঞ ছিল রাষ্ট্রীয় বর্বরতার চরম নিদর্শন। তারা বলেন, ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার এখনও হয়নি। বরং অনেক আলেমকে মিথ্যা মামলায় হয়রানি করা হয়েছে, যা এখনো নিষ্পত্তি হয়নি।
ছাত্র জমিয়ত অবিলম্বে শাপলা ট্র্যাজেডির নিরপেক্ষ তদন্ত, দায়ীদের শাস্তি এবং সকল মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের জোর দাবি জানিয়েছে।
জাগপার সমাবেশ: শেখ হাসিনা ও সংশ্লিষ্টদের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে বিচার দাবি
পল্টনে জাগপার কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের আয়োজনে বক্তব্য রাখেন দলের মুখপাত্র রাশেদ প্রধান।
তিনি বলেন, “শাপলা গণহত্যা ছিল পরিকল্পিত; এর পেছনে ছিল ভারতীয় হিন্দুত্ববাদ প্রতিষ্ঠার গভীর ষড়যন্ত্র।”
তাঁর দাবি, “শেখ হাসিনা ও সংশ্লিষ্টদের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে বিচার করতে হবে।”

ইনকিলাব মঞ্চের বিক্ষোভ
মতিঝিলের শাপলায় ইনকিলাব মঞ্চের বিক্ষোভ ; দ্রুত বিচার দাবি
মতিঝিলের শাপলা চত্বরে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে ইনকিলাব মঞ্চ। শরীফ আল হাদী’র নেতৃত্বে এ প্রতিবাদ বিক্ষোভে অংশ নেয় শত শত যুবক। এসময় তারা শাপলায় গণহত্যার বিচার দাবি করে।
শাপলা ট্রাজেডির ইতিহাস জাতীয় পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্তির দাবি
ছাত্র জমিয়তের সিনিয়র সহ-সভাপতি আহমদ ইসলামাবাদী দাবি করেন, “শাপলা ট্রাজেডির ইতিহাস দেশের প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।”
তিনি বলেন, “এই ঘটনা কেবল রাজনৈতিক নয়, এটি বিশ্বাস-ভিত্তিক মূল্যবোধের ওপর আঘাত।’
তিনি স্বাধীন তদন্ত কমিশন ও আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের দাবি জানান।
উল্লেখ্য, শাপলা ট্রাজেডি শুধু একটি রাতের গণহত্যা নয়, বরং তা বাংলাদেশে রাজনৈতিক দমন-পীড়নের এক নির্মম চিত্র। প্রতিবছর এই দিনে জনমনে ঘৃণা, শোক এবং প্রতিশোধের আগুন নতুন করে জ্বলে ওঠে। মানুষ চায় সত্য উদঘাটন হোক, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হোক। এই আন্দোলন প্রমাণ করে, ইতিহাস কখনো চাপা দিয়ে রাখা যায় না। সময়ের দাবিতেই সত্য একদিন সামনে আসবেই— হয় আদালতের কাঠগড়ায়, নয় ইতিহাসের আদালতে।
হাআমা/