ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধবিরতি: কেন এখন? কার লাভ, কার কৌশল?

by hsnalmahmud@gmail.com

হাসান আল মাহমুদ >>

দীর্ঘদিনের উত্তেজনার পর অবশেষে ভারত ও পাকিস্তান যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, যিনি দাবি করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় দুই দেশের মধ্যে এই সমঝোতা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন
banner

ট্রাম্প তাঁর নিজস্ব সামাজিক মাধ্যম ট্রুথ সোশ্যাল-এ দেওয়া এক বিবৃতিতে বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় দীর্ঘ এক রাতের আলোচনার পর, আমি আনন্দের সঙ্গে ঘোষণা দিচ্ছি ভারত ও পাকিস্তান পূর্ণ এবং তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছে। নিজেদের সঠিক জ্ঞান ও অসাধারণ বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করায় দুই দেশকে অভিনন্দন।”

যুদ্ধবিরতির বিষয়টি ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশই আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করেছে।

পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার বলেন, “পাকিস্তান সবসময় এই অঞ্চলে শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য সংগ্রাম করে এসেছে। তবে সার্বভৌমত্ব এবং অখণ্ডতা নিয়ে কখনোই আপস করেনি।”

অন্যদিকে, ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি জানিয়েছেন, “ভারত ও পাকিস্তান উভয়ই স্থল, আকাশ ও সমুদ্রে সব ধরনের গুলিবর্ষণ এবং সামরিক পদক্ষেপ বন্ধ করবে। এই যুদ্ধবিরতি আজ বিকাল ৫টা থেকে কার্যকর হয়েছে।”

উত্তেজনার পেছনের প্রেক্ষাপট
গত ২২ এপ্রিল কাশ্মীরের পেহেলগাম এলাকায় বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জন নিহত হয়। ভারত এর দায় পাকিস্তানের ওপর চাপিয়ে দেয় এবং এরপর রাতের আঁধারে পাকিস্তানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। এতে পাকিস্তানে হতাহতের ঘটনা ঘটে।

জবাবে পাকিস্তান ভারতের বিমান ও ড্রোন ভূপাতিত করার দাবি করে এবং ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটিগুলোতেও পাল্টা হামলা চালায়।

সীমান্ত ও কাশ্মীরে এ ধরনের টানা উত্তেজনায় আন্তর্জাতিক মহলে গভীর উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে। জাতিসংঘ ও বিভিন্ন শান্তিপ্রিয় রাষ্ট্র এ পরিস্থিতির দ্রুত অবসান চেয়ে বিবৃতি দেয়। শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় এই যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়।

বিশ্লেষকদের মতে, এই যুদ্ধবিরতি যদি বাস্তবে কার্যকর ও দীর্ঘস্থায়ী হয়, তবে দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন করে শান্তির সম্ভাবনা তৈরি হবে।

ভিন্ন চোখে যুদ্ধবিরতির কারণ

এই যুদ্ধবিরতির পেছনে রয়েছে বহুস্তরবিশিষ্ট কৌশলগত ও রাজনৈতিক কারণ। এই গবেষণামূলক প্রতিবেদনে বিশ্লেষণ করব—কেন এখন যুদ্ধ থেমে গেল, কে উপকৃত, কার স্বার্থ রক্ষা হলো এবং এর পেছনে ভেতরের গাণিতিক হিসাবটা আসলে কী?

যদি আজ পাকিস্তান একপাক্ষিকভাবে দুর্বল হতো, তাহলে কি যুদ্ধ থামত? সন্দেহ হয়। বরং ট্রাম্প এবং পশ্চিমা শক্তিগুলো চুপচাপ বসে থাকত, কিংবা সম্ভাব্য ‘সন্ত্রাস দমন’ নামে ভারতের হামলাকে ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা করত।

যুক্তরাষ্ট্রের ‘প্যাকেজ ডিপ্লোম্যাসি’:

যুক্তরাষ্ট্র ইতিহাসে বহুবার এই প্যাটার্নে চলেছে, প্রথমে দুই পক্ষের উত্তেজনাকে প্রশ্রয় দেওয়া,পরে এক পক্ষ দুর্বল হয়ে পড়লে মধ্যস্থতার নামে আরেক পক্ষকে অস্ত্র সহায়তা দিয়ে ‘প্রভাব বলয়’ তৈরি করা। ইসরায়েলের মডেল-টাই এখন কার্যকর হচ্ছে। ভারতকে মধ্যপ্রাচ্যের নতুন “সন্ত্রাসবিরোধী ঘাঁটি” বানানোই হতে পারে তাদের কৌশল, যেখানে পাকিস্তান, চীন এবং ইরানকে ঘিরে একটি ঘূর্ণিবলয় তৈরি করা হবে।

ভারত কী সত্যিই দুর্বল হয়ে পড়েছে?

বর্তমানে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপ (বেকারত্ব, কৃষক অসন্তোষ), সীমান্তে একসঙ্গে দুই ফ্রন্টে যুদ্ধ (চীন ও পাকিস্তান),আন্তর্জাতিক মহলে মানবাধিকার প্রশ্নে সমালোচনার মুখে পড়া এসব পরিস্থিতি মিলিয়ে ভারত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থায় ছিল না। ফলে, যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও এটা ছিল ‘এগিয়ে না গিয়ে পেছনে টেনে আনার সময়’। তবে এই পিছিয়ে আসা সাময়িক—ভবিষ্যতে ভারতে অস্ত্র ঢুকবে। যুদ্ধ থামল, কারণ ভারত দুর্বল—এবার কী তাকে ‘ইসরায়েল মডেল’-এ তৈরি করবে আমেরিকা?

সীমান্তে চীনের হুমকি: লাদাখ অঞ্চলে চীনের উপস্থিতি ভারতকে একসাথে দুই ফ্রন্টে লড়তে বাধ্য করতো—পাকিস্তান ও চীন।

আন্তর্জাতিক সমালোচনা: মানবাধিকার, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও কাশ্মীর ইস্যুতে পশ্চিমা গণমাধ্যমে ভারতের ভাবমূর্তি চাপে রয়েছে।

এই পরিস্থিতিতে, ভারত একটি দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থানে ছিল না। ফলে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন মধ্যস্থতা করল, তখন ভারতের পক্ষ থেকেই যুদ্ধ থামানোর আগ্রহ বেশি ছিল।

পাকিস্তানের অবস্থান: ‘দুর্বল কিন্তু বিপজ্জনক’

পাকিস্তান অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হলেও সামরিকভাবে প্রস্তুত, এবং চীন, ইরান ও রাশিয়ার সঙ্গে কৌশলগত ঘনিষ্ঠতা এই মুহূর্তে তাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ ‘স্ট্র্যাটেজিক কার্ডে’ পরিণত করেছে। পাকিস্তানের দুর্বলতা থাকলেও তা সামরিক প্রতিরোধ ক্ষমতা থেকে নয়—বরং অর্থনীতিতে।

এই অবস্থায় সরাসরি যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী দেশজ চাপে উত্তাল হয়ে উঠত, আর আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতকে আক্রমণকারী দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা যেত।

মার্কিন কৌশল: ভারতকে ‘ইসরায়েল মডেল’-এ তৈরি করা?

যুদ্ধ থামানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র যে ‘উদার’ ভূমিকা নিল, তা আসলে কৌশলগত অবস্থান পুনর্গঠনের সূচনা মাত্র। ইতিহাস বলছে—যুক্তরাষ্ট্র কখনোই সরাসরি যুদ্ধ থামিয়ে শান্তি চায়নি; বরং যুদ্ধ-পরবর্তী ব্যবস্থায় তাদের প্রভাব নিশ্চিত করতে চেয়েছে।

আমেরিকা ইতিমধ্যে ভারতের সঙ্গে ্মচুক্তি, ড্রোন, এয়ার ডিফেন্স, সাইবার ও স্যাটেলাইট সহযোগিতা বৃদ্ধি করেছে, Quad ও Indo-Pacific অঞ্চলে ভারতকে চীন প্রতিরোধে ‘ফ্রন্টলাইন নেশন’ হিসেবে গড়ে তুলছে।

এ কৌশল অনেকটা ইসরায়েলের মতোই—যেখানে দেশটি হয় আঞ্চলিক প্রতিপক্ষকে দমনকারী অস্ত্রশক্তিধর মিত্র, আবার মার্কিন অস্ত্রশিল্পের বড় বাজার।

ভারতের জন্য পরবর্তী ধাপ হতে পারে: বিশাল সামরিক প্যাকেজ (F-35, সাইবার ডিফেন্স), কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক নজরদারি প্রযুক্তি, এবং সরাসরি প্রশিক্ষণ সহযোগিতা।

পরিণতি ও সতর্কতা

ভারতের জনগণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো—আমরা কি সত্যিই স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিচ্ছি, নাকি কৌশলগত মোহে একটি বৈশ্বিক যুদ্ধের হাতিয়ারে পরিণত হচ্ছি?

আর পাকিস্তানের জন্য—এই যুদ্ধবিরতির সুযোগে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি এবং কূটনৈতিক লবি শক্তিশালী করা জরুরি।

এই যুদ্ধবিরতি হলো সময় কেনার নামান্তর—যেখানে আমেরিকা, ভারত ও পাকিস্তান সবাই নিজস্ব ছক কষছে। কিন্তু সবার উদ্দেশ্য এক নয়। পাকিস্তান চায় টিকে থাকতে—আঞ্চলিক ও অর্থনৈতিক চাপে। ভারত চায় প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে—চীন ও ইসলামাবাদের বিরুদ্ধে। আর আমেরিকা চায় দক্ষিণ এশিয়ার নিয়ন্ত্রণ—ইসরায়েলের স্টাইলে। এই প্রেক্ষাপটে, শান্তির বাস্তব পথ শুধু যুদ্ধ থামানো নয়—সার্বভৌমতার ভারসাম্য রক্ষা, কূটনৈতিক স্বচ্ছতা ও জনগণের সচেতনতা।

হাআমা/

banner

এ জাতীয় আরো সংবাদ

প্রকাশক: আবু সায়েম খালেদ
পরিচালক: এইচ. এম. মুহিউদ্দিন খান
আসকান টাওয়ার, ৬ষ্ঠ তলা, ১৭৪ ধোলাইপাড়
যাত্রাবাড়ী, ঢাকা-১২০৪
ইমেইল: info@36news24.com
ফোন: 01401 400222