মুফতি ইমাম মো: রেযাউল কারীম বুরহানী >>
মানব শিশু মানবতার প্রতি আল্লাহ তায়ালার বিরাট নিয়ামত বা দান। সে দানের জন্য আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা আমাদের অপরিহার্য কর্তব্য। ইসলামে কৃতজ্ঞতা বা শোকর আদায় বলতে বোঝায়– দানপ্রাপ্ত বস্তুর যথার্থ মূল্যায়ন ও ন্যায্য ব্যবহার, যাতে আল্লাহ নিয়ামতের প্রবাহ অব্যাহত রাখেন। আল্লাহর রহমত ও নিয়ামতের অব্যাহত প্রবাহের প্রতিশ্রুতি অনুসারে ইব্রাহীম আ.-এর ঘরে এক এক করে দু’জন মহামানব ইসমাঈল আ. ও ইসহাক আ. আবির্ভূত হয়েছিলেন। আল্লাহর প্রতি নিজের শিশু সন্তানের জন্য তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা ছিল– সব প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি আমাকে বৃদ্ধ বয়সে ইসমাঈল ও ইসহাককে দান করেছেন। আমার রব অবশ্যই প্রার্থনা শোনেন।’ [আল-কুরআন ১৪:৩৯]
‘হে আমাদের রব! আমি আমার শিশুদের তোমারই সম্মানিত ঘরের কাছে শস্যবিহীন অনুর্বর উপত্যকায় বসবাস করতে রেখে গেলাম। প্রভু! সেখানে তারা সালাত কায়েম করবে। তুমি মানবজাতির হৃদয়কে তাঁদের প্রতি আকৃষ্ট করে দিও এবং তাঁদেরকে ফলমূলের আহার্য সরবরাহ করো। অবশ্যই তারা তোমার কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনকারী থাকবে।’ [আল-কুরআন ১৪:৩৭]
‘আর্থিক অনটনের জন্য তোমরা নিজেদের সন্তানকে হত্যা করো না, আমি তোমাদেরকে যেভাবে জীবিকা দান করি তাদেরকেও অনুরূপভাবে দান করব। [আল-কুরআন ৬:১৫১]
‘অভাবের ভয়ে তোমরা তোমাদের শিশুদের হত্যা করো না, আমি তাদেরকে ও তোমাদেরকে রিজিক দান করি। তাদেরকে হত্যা করা মহাপাপ।’ [আল-কুরআন ১৭:৩১]
‘হে রব! তুমি আমাকে এমন উত্তরাধিকারী দান করো যে আমার এবং ইয়াকুব বংশের প্রতিনিধিত্ব করবে এবং হে প্রভু! সে যেন তোমার সন্তুষ্টি লাভ করতে সক্ষম হয়।’ [আল-কুরআন ১৯:৫-৬]
‘স্মরণ করো, যখন লুকমান উপদেশ হিসেবে তাঁর পুত্রকে বললো, হে বৎস! আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক করো না। অবশ্যই শিরক চরম জুলুম।’ [আল-কুরআন ৩১:১৩]
‘হে বৎস! সলাত কায়েম করো, সৎ কাজের আদেশ দাও এবং অসৎ কাজের নিষেধ করো, আর বিপদে-আপদে ধৈর্য ধারণ করো। এটাই তো দৃঢ় সংকল্পের কাজ।’ [আল-কুরআন ৩১:১৭]
‘অহংকার বশে তুমি মানুষকে অবজ্ঞা করো না এবং পৃথিবীতে উদ্ধতভাবে বিচরণ করো না। কারণ আল্লাহ কোনো উদ্ধত অহংকারীকে পছন্দ করেন না।’ [আল-কুরআন ৩১:১৮]
‘তুমি সংযতভাবে পদচারণা করো এবং কণ্ঠস্বর নিচু রাখো। সব কণ্ঠস্বরের মধ্যে গাধার স্বরই সবচেয়ে অপ্রীতিকর।’ [আল-কুরআন ৩১:১৯]
“কোনো পিতা তার সন্তানকে উত্তম আদব শেখানোর চাইতে আর কোনো মূল্যবান পুরস্কার দিতে পারে না।” [ইমাম তিরমিযী, আস-সুনান, অধ্যায়: আল বিররু ওয়াস্ সিলাহ, অনুচ্ছেদ: মা জাআ ফি আদাবিল অলাদি, খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা: ৩৩৮]
আমাদের করণীয়
মানব শিশুর মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় ইসলামের সর্বপ্রথম অবদান হলো বেঁচে থাকার অধিকার প্রদান। আর বেঁচে থাকার অধিকারের মধ্যে রয়েছে জীবনধারণে সহায়ক মৌলিক বিষয়াদির অধিকার। যেমন: স্বাস্থ্য রক্ষা, খাদ্য-পানীয় এবং বাস উপযোগী পরিবেশ নিশ্চিত করা।
ইসলামের নির্দেশ হলো, সন্তানের ভরণ-পোষণের জন্য সম্ভাব্য সব আয়োজন যথাবিহিত ব্যবস্থা করা। ইসলামী নিয়মনীতি অনুসারে শিশু সন্তানের খাওয়া-দাওয়া, বাসস্থান, পোশাক-পরিচ্ছদ, চিকিৎসা, প্রতিপালন এবং শিক্ষা-দীক্ষার তত্ত্বাবধান প্রতিটি মানুষের জন্য বাধ্যতামূলক (ফরয)। [জাওয়াহিরুল কালাম, আল্লামা সাইয়েদ ইবনে হাসান নাজাফী-এর বরাতে, উসুলুত্ তারবিয়াহ (বাংলা অনুবাদ), তা, বি, পৃষ্ঠা: ২৫]
মানব শিশুর মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় ইসলামের অন্যতম প্রধান অবদান হলো শিশুদের সুশিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। ইসলাম শিশুর অভিভাবকের উপর দায়িত্ব দিয়েছে শিশুদের জাগতিক ও আত্মিক উন্নয়নের সুব্যবস্থা করার।
সন্তানের শারীরিক ও মানসিক উৎকর্ষ লাভে সাহায্য করার লক্ষ্যে পিতা-মাতার প্রতি দায়িত্ব আরোপ করা হয়েছে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও নৈতিক শিক্ষা-দীক্ষার মাধ্যমে শিশুকে সুনাগরিক ও সচ্চরিত্রবান রূপে গড়ে তোলার। এর মাধ্যমেই একজন মানব শিশু সত্যিকার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। ধ্যান-ধারণা ও চিন্তার প্রগতিশীলতার ক্ষেত্রে সন্তানকে সমাজের কাছে বরণীয় এবং মানব জাতির গৌরব হিসেবে উপস্থাপিত করতে পারাই হচ্ছে শিশুর আসল মর্যাদা। সন্তানকে তার সমসাময়িক রীতি ও সাংস্কৃতিক মানদণ্ডে উঁচু পর্যায়ে উন্নীত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
মানব শিশুকে মর্যাদাবান, কর্মকুশলী, দক্ষ, সুশীল ন্যায়পরায়ণ, নিয়ম শৃঙ্খলানুবর্তী, আদর্শরূপে গড়ে তোলা প্রয়োজন। ইসলাম এ কাজগুলোরই দায়িত্ব দিয়েছে পিতা-মাতা ও অভিভাবককে। তারা সন্তানদের প্রকৃত শিক্ষা-দীক্ষার মাধ্যমে যেন গৌরবময় জীবনের অধিকারী করে তোলে। এ কাজে সামান্য গাফিলতি করাকে তিরস্কার করা হয়েছে। হযরত লুকমান (আ.) তাঁর সন্তানকে যে উপদেশ দিয়েছিলেন তা পবিত্র কুরআনে উল্লিখিত হয়েছে, সন্তানকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সেটাই হচ্ছে উত্তম পদ্ধতি।
ইসলামের দৃষ্টিতে শিশুর অধিকারসমূহ নিশ্চিত করা। যেমন:
(১) জন্মের পরপরই কানে আযানের ধ্বনি শুনার অধিকার (২) নবজাতকের জন্য তাহনীক এর অধিকার
(৩) মায়ের দুধ পানের অধিকার (৪) ভালো বা উত্তম নাম পাওয়ার অধিকার
(৫) সপ্তম দিনে আক্বীকার অধিকার (৬) খতনার অধিকার (৭) উত্তম পোশাক পরিধানের অধিকার
(৮) সুষম খাদ্যের অধিকার (৯) শারীরিক ও মানসিক বিকাশের অধিকারসমূহ। যেমন:
(ক) শারীরিক বিকাশ (খ) মানসিক বিকাশ (গ) ভাষাগত বিকাশ (ঘ) সামাজিক বিকাশ (ঙ) অনুভূতির বিকাশ
(চ) নৈতিক বিকাশ (ছ) শিক্ষার অধিকার (জ) পরিচর্যা লাভের অধিকার (ঝ) সুরক্ষা ও রক্ষণাবেক্ষণ পাওয়ার অধিকার
(১০) গর্ভকালীন নিরাপত্তার অধিকার (১১) শৈশবকালীন পারিবারিক নিরাপত্তা পাবার অধিকার
(১২) শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাতায়াতকালীন নিরাপত্তার অধিকার (১৩) বয়ঃসন্ধিকালীন নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার
(১৪) পরিবেশগত নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার (১৫) দুর্যোগকালীন নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার
(১৬) গোলমাল, মারামারি ও যুদ্ধকালীন নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার (১৭) উত্তম চারিত্রিক গুণাবলী অর্জনের অধিকার
(১৮) বৈষম্যহীন আচরণ পাওয়ার অধিকার (১৯) উত্তম বন্ধুদের সাহচর্যের অধিকার
(২০) শ্রমসাধ্য কাজ থেকে শিশু বয়সে মুক্ত থাকার অধিকার (২১) খেলাধূলা, বিনোদন ও শিশুর শরীর চর্চার অধিকার
(২২) বিভিন্ন নির্যাতনসহ যৌন নির্যাতন থেকে রক্ষা পাওয়ার অধিকার (২৩) হত্যা ও পাচার থেকে মুক্ত থাকার অধিকার।
মানব শিশুর জন্য ইসলামের অবদান হলো পিতা-মাতাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তাদের সন্তানের শারীরিক ও মানসিক উন্নয়নের সুব্যবস্থা নিশ্চিত করতে, যাতে সন্তান সমাজে-সংসারে সৎ ও আদর্শ নেতৃত্ব প্রদান করতে পারে। ইসলামই প্রথমে শিশুর বেঁচে থাকার অধিকার ঘোষণা করেছে। প্রাচীন সমাজে যেখানে শিশু সন্তানকে অপাংক্তেয় মনে করা হতো সেখানে ইসলাম ঘোষণা করেছেন তাদের জীবনের অধিকার। কার্যকর শিক্ষাকৌশল ও শিক্ষার বিষয়বস্তুর ভিত্তিতে আমাদের শিশুদের উপযুক্ত রূপে গড়ে তুলতে হবে।
লেখক : ইমাম ও খতিব, দৌলতখান মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র
এনএ/