হাসান আল মাহমুদ >>
বর্তমান সময়ে নারীর অধিকার ও স্বাধীনতা নিয়ে নানা রকম উদ্যোগ দেখা গেলেও কিছু আন্দোলন প্রকৃতপক্ষে নারীর মর্যাদা রক্ষা নয়, বরং ধর্ম, পরিবার এবং সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে সূক্ষ্ম সাংস্কৃতিক আঘাত হয়ে উঠছে। “নারীর ডাকে মৈত্রীর যাত্রা” নামের সাম্প্রতিক একটি কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে বিতর্ক ও উদ্বেগ দানা বেঁধেছে।
রেনিসা প্ল্যাটফর্মের পক্ষ থেকে মুসলিম নারীরা এ কর্মসূচিকে স্পষ্ট ভাষায় প্রত্যাখ্যান করেছে। তাঁদের ভাষ্য মতে, এটি একপ্রকার ধর্ম, সমাজ ও পরিবারবিরোধী ষড়যন্ত্র, যার মূল উদ্দেশ্য ইসলামি জীবনব্যবস্থাকে দুর্বল করা এবং নারীর প্রকৃত সম্মান বিনষ্ট করা।
ধর্ম ও সমাজবিরোধী সুপারিশ : বিপজ্জনক প্রবণতা
নারী সংস্কার কমিশনের বেশ কিছু সুপারিশ যেমন: উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে সমান ভাগ, পতিতাবৃত্তিকে স্বীকৃতি, বৈবাহিক ধর্ষণ আইন প্রণয়ন – এসব ইসলামের নির্ধারিত বিধান এবং আমাদের সামাজিক নৈতিকতার পরিপন্থী। এসব বাস্তবায়ন হলে সমাজে ধর্মহীনতা ছড়াবে, পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হবে এবং সামাজিক ভারসাম্য ভেঙে পড়বে।
উত্তরাধিকার ইস্যুতে ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি
ইসলামে নারীর জন্য নির্দিষ্ট উত্তরাধিকার অংশ রয়েছে, যার পেছনে রয়েছে দায়-দায়িত্বভিত্তিক সুবিচার। নারীর উপার্জনের বাধ্যবাধকতা নেই, তবে পুরুষদের ওপর রয়েছে পরিবার চালানোর দায়িত্ব। এই প্রেক্ষাপটে সমান সম্পত্তির দাবি ন্যায্য নয়, বরং দায়িত্বহীন অধিকার একপ্রকার অবিচার।
পতিতাবৃত্তি স্বীকৃতি: মর্যাদা নয়, অপমান
পতিতাবৃত্তিকে পেশা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া নারীর মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করে। এটি নারীর সম্মান নষ্ট করে তাকে একটি ভোগ্যপণ্য হিসেবে উপস্থাপন করে—যা ধর্মীয় ও সামাজিক উভয় দিক থেকেই অনৈতিক।
বৈবাহিক ধর্ষণ আইন: সম্পর্ককে অপরাধের স্তরে নামিয়ে আনা
স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক পারস্পরিক ভালোবাসা, দায়িত্ববোধ ও বোঝাপড়ার উপর দাঁড়িয়ে থাকে। এই সম্পর্ককে ‘ধর্ষণ’ আখ্যা দিয়ে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ আনা পারিবারিক সম্পর্কের স্বাভাবিকতা বিনষ্ট করে দিতে পারে। ইসলামে সমস্যা হলে বিচারের সুযোগ আছে, কিন্তু সম্পর্ককে বিকৃতভাবে ব্যাখ্যার অনুমোদন নেই।
নারীর পরিচয়কে ভাঙার চক্রান্ত
নারীকে কেবল ‘স্বাধীন ভোক্তা’ হিসেবে তুলে ধরার প্রবণতা বিভ্রান্তিকর। মা, স্ত্রী, কন্যা—এই পরিচয়গুলোকে ছোট করে আত্মকেন্দ্রিক পরিচয় গঠন নারীর প্রকৃত পরিচয়কে বিকৃত করে। অথচ বাস্তব জীবনে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তার মতো মৌলিক সমস্যা নিয়ে তাদের কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই।
লিঙ্গ বৈচিত্র্যের নামে সমকামিতার স্বীকৃতি: একটি সাংস্কৃতিক আগ্রাসন
‘লিঙ্গ বৈচিত্র্য’ ও ‘সমতা’র নামে যেভাবে সমকামিতা এবং অন্যান্য বিকৃত আচরণকে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে, তা মূলত ধর্ম, পরিবার এবং সমাজব্যবস্থার ওপর সাংস্কৃতিক আঘাত। এটি একটি পরিকল্পিত পশ্চিমা ধাঁচের মূল্যবোধ চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা।
সম্প্রতি “নারীর ডাকে মৈত্রী যাত্রা” নামক কর্মসূচি ঘিরে দেশের রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক অঙ্গনে শুরু হয়েছে তুমুল বিতর্ক। এই কর্মসূচিকে ঘিরে যে ধরনের দাবি ও বক্তব্য উঠে এসেছে, তা শুধু ধর্মীয় বিশ্বাস ও পারিবারিক কাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিকই নয়, বরং এর অন্তরালে রয়েছে এক প্রকার আদর্শিক বিভ্রান্তি ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শঙ্কা।
প্রচারের মুখে ‘অধিকার’, অন্তরে ইসলামবিদ্বেষ?
নারী সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী যেসব দাবি সামনে এসেছে—উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে সমান ভাগ, পতিতাবৃত্তিকে বৈধতা, বৈবাহিক ধর্ষণের আইন, লিঙ্গ বৈচিত্র্যের নামে সমকামিতার স্বীকৃতি—এগুলো ধর্মীয় ও নৈতিক কাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ইসলাম নারীর মর্যাদা দেয়, কিন্তু পুরুষের প্রতিদ্বন্দ্বী করে না।
এই সংস্কারের মাধ্যমে নারীর প্রকৃত সমস্যা যেমন—শিক্ষা, নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান—সেসবের কোনো বাস্তব সমাধান নেই। বরং এগুলো নারীর আত্মপরিচয় ও ধর্মীয় অবস্থানকে দুর্বল করার পাঁয়তারা বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
সমালোচনার ঝড় সামাজিক মাধ্যমে
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই আন্দোলনকে ঘিরে চলছে তীব্র সমালোচনা। অনেকেই এটিকে ‘নারীর নামে নারীবিদ্বেষ’ বলেও উল্লেখ করেছেন।
রিদওয়ান হাসান (সাবেক এনসিপি নেতা) বলেন, “নারী মৈত্রীর নামে পরিকল্পিত নারী অবমাননার দায় আয়োজকদের নিতে হবে। এদেরকে লিগ্যাল নোটিশ পাঠানো উচিত।”
মুফতি আবুল ফাতাহ কাসেমী বলেন, “আন্দোলনের শিরোনাম ‘নারীর ডাকে মৈত্রী যাত্রা’, কিন্তু দাবি—সেনাশাসন হটাও! এটা কেমন অদ্ভুত সমন্বয়?”
গবেষক ইফতেখার জামিল বলেন, “নারী কমিশনের রিপোর্টে ইসলামোফোবিয়ার প্রবল উপস্থিতি রয়েছে। যারা এসব শর্তহীনভাবে সমর্থন করেন, তাদের বিবেকবোধ প্রশ্নবিদ্ধ।”
মুফতি শামসুদ্দোহা আশরাফী বলেন, “আন্দোলনের শিরোনাম ও দাবির মধ্যে কোনো সুসংগতির অভাব রয়েছে। এটা একধরনের আদর্শিক ধোঁকাবাজি।”
এদিকে সাংবাদিক কাউসার লাবীব ‘বেশ্যার ন্যায্য হিস্যা চাই’ নারী মৈত্রীর এমন প্ল্যাকার্ডের ছবি পোস্ট করে লিখেন বলেন, কী চমৎকার ছন্দ মিল! অন্যকেউ এই উপাধিতে ডাকলে আবার চেইতেন না।
তিনি বলেন, আর হিস্যা চান, ওকে। খুবই ভালো কথা। তাবৎ দুনিয়ার সবাই সবার হিস্যা বুঝে নেওয়ার অধিকার আছে। কিন্তু আপনারা পাবলিক প্ল্যাসে কী করেন! আপনাদের অধিকার তো আপনারা আপনাদের ক্লায়েন্টদের কাছ থেকে সার্ভিস দেওয়ার সময়-ই বুঝে নেওয়ার দরকার। তখন বুঝে না নিয়ে এখন আন্দোলন করলে হবে! বুঝে না—বোকা।
আরেকটা বিষয় হলো—আজকে কাদের আন্দোলন ছিল, সেটা প্লে-কার্ডে লিখে জানিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যানার দেখে বুঝতে পারি নি—আজ কারা একত্রিত হচ্ছে।
উল্লেখ্য, ‘মৈত্রী যাত্রা” শিরোনামে প্রচারিত এই আন্দোলন আদৌ নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রকৃত উদ্যোগ কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে জনমনে। নারীর সম্মান ও নিরাপত্তার নামে যদি ধর্মীয় বিশ্বাস ও পারিবারিক বন্ধনকে আঘাত করা হয়, তাহলে তা আদর্শ নয়, বরং বিভ্রান্তি। নারীর সম্মান রক্ষা, শিক্ষা, নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা সময়ের দাবি। তবে এসব আড়ালে ধর্ম, পরিবার এবং সমাজবিরোধী এজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। মুসলিম নারীদের উচিত সচেতন থাকা, ইসলামি মূল্যবোধকে আঁকড়ে ধরা এবং বিভ্রান্তিকর আন্দোলনের ফাঁদ থেকে নিজেকে ও সমাজকে রক্ষা করা।
হাআমা/