হাসান আল মাহমুদ >>
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পদত্যাগের গুঞ্জনে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা ধরনের আলোচনা ও মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, নেতৃবৃন্দ এ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। একদিকে রয়েছে তার দায়িত্ব পালনের প্রতি আহ্বান, অন্যদিকে রয়েছে দায়িত্বে অব্যাহত থাকা বা পদত্যাগ নিয়ে বিভ্রান্তি ও আশঙ্কা।
এনসিপির আহ্বান: দায়িত্বে থেকে সংস্কার সম্পন্ন করুন
এনসিপি আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, ড. ইউনূসকে জনগণের প্রতি দেওয়া সংস্কার, বিচার ও ভোটাধিকারের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে হবে। তিনি বলেন, “উনাকে দায়িত্বে থেকেই রাজনৈতিকভাবে সকল সমস্যার সমাধান করতে হবে।” তিনি ঘোষণা দেন যে, নির্বাচনের পূর্বে মৌলিক সংস্কারের ভিত্তিতে জুলাই সনদ রচিত হবে, এবং সেই অনুযায়ী জুলাই গণহত্যার বিচার দৃশ্যমান ও তার রোডম্যাপ প্রণীত হতে হবে।
নাহিদ ইসলাম আরও বলেন, নতুন সংবিধানের জন্য গণপরিষদ ও আইনসভার নির্বাচন একসাথে দিতে হবে। পাশাপাশি দেশপ্রেমিক, বাংলাদেশপন্থী ও ধর্মপ্রাণ ছাত্র-জনতাকে ঐক্যবদ্ধ থেকে ফ্যাসিবাদ ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে আহ্বান জানান। সেনা অফিসার ও সৈনিকদের প্রতিও দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানান।
বিএনপি: পদত্যাগ তাদের দাবি নয়
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, “ড. ইউনূস পদত্যাগ করতে চাইলে সেটা তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত হতে পারে। আমরা (বিএনপি) কখনও তার পদত্যাগ দাবি করিনি।” তিনি বলেন, “নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা না করে যদি তিনি দায়িত্ব ছেড়ে দিতে চান, সেটিও তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে একান্তই যদি তিনি দায়িত্ব পালনে অপারগ হন, তাহলে রাষ্ট্র নিজ দায়িত্বে বিকল্প ব্যবস্থা নেবে।”
তিনি আরও বলেন, “এই পৃথিবীতে কেউ অপরিহার্য নয়। তবে আমরা আশা করি, তিনি একজন বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিষয়টির গুরুত্ব বুঝবেন এবং জাতির প্রত্যাশা অনুযায়ী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে একটি নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করবেন।”
ইসলামী আন্দোলনের আহ্বান: জনগণের সমর্থন আপনাকে দায়িত্ব দিয়েছে
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম (পীর সাহেব চরমোনাই) বলেন, “অভ্যুত্থান পরবর্তী দেশের মানুষে অভূতপূর্ব অকুণ্ঠ সমর্থনে আপনাকে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছে। আপনার দায় শহীদদের রক্ত ও আহতদের বেদনার প্রতি।” তিনি বলেন, “১৮ কোটি জনতার দেওয়া দায়িত্ব আপনি অবিচলতার সাথে পালন করুন। দেশবাসী আপনার পাশে ছিল, আছে এবং থাকবে ইনশাআল্লাহ।”
তিনি আরও বলেন, “রাষ্ট্রের সকল সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব-কর্তব্য ও কর্মপরিধি সুনির্দিষ্টভাবে বলা আছে। কোনভাবেই এর ব্যত্যয় ঘটানো যাবে না। রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা রক্ষায় সকল প্রতিষ্ঠানকে নিজ কর্মপরিধির মধ্যে থাকতে হবে।”
খেলাফত ও হেফাজতের প্রতিক্রিয়া: মান-অভিমান নয়, দায়িত্ব পালন জরুরি
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমীর ও হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব আল্লামা মামুনুল হক বলেন, “প্রফেসর ইউনূস সাহেব জাতির অভিভাবকের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। আমাদের সেনাপ্রধান বাংলাদেশের অন্যতম স্তম্ভ, আপনারা যার যার জায়গা থেকে দায়িত্ব পালন করুন।” তিনি বলেন, “ব্যক্তিগত মান-অভিমান এ দেশের ১৮ কোটি মানুষের স্বপ্নকে ফিকে হতে দিতে পারে না।”
তিনি বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দলকে আহ্বান জানান, “এভাবে আল্টিমেটাম দিয়ে, টাইমফ্রেম বেঁধে দিয়ে দেশকে সামনের দিকে অগ্রসর করা সম্ভব হবে না। সহনশীল অবস্থানে আসুন। প্রত্যেকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করুন।”
তিনি আরও বলেন, “দুর্বৃত্তায়নের নির্বাচনী ব্যবস্থায় এ দেশের মানুষ বিশ্বাস করে না। এই কালচার অব্যাহত থাকলে দেশ ধ্বংসের দিকে যাবে।” তিনি রাজনৈতিক ঐক্য গঠনের আহ্বান জানান, যাতে করে ষড়যন্ত্রকারীদের রুখে দেয়া যায়।
জমিয়তের বিবৃতি: দায়িত্বশীল আচরণ ও জাতীয় ঐক্যের আহ্বান
জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ বলেছেন, “দেশের মানুষ মনেপ্রাণে চায়, গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশ যেন আর কখনোই ভুল পথে না যায়।” তারা দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী, আপামর জনতা ও রাজনৈতিক দলসমূহকে দায়িত্বশীল আচরণের আহ্বান জানান।
তারা বলেন, “রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত সকলকে এবং ছোট-বড় সব রাজনৈতিক দলকে সংবেদনশীল ও সংযত আচরণ করতে হবে। রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে সব মহলেরই উচিত অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া।”
বিএনপি নেতা জয়নুল আবদিন ফারুকের বক্তব্য: আপনি বাংলাদেশের ১৮ কোটির ইউনূস
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জয়নুল আবদিন ফারুক বলেন, “আপনি ব্যক্তি ইউনূস নন, বাংলাদেশের ১৮ কোটির ইউনূস।” তিনি বলেন, “নির্বাচনের জন্য আপনাদের বসিয়েছিলাম। ৯ মাস হয়ে গেলো নির্বাচনের রোডম্যাপ দেয়া হচ্ছে না।” তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, “পত্রিকায় দেখেছি, আপনি নাকি বলেছেন, ‘আমার পদত্যাগ করা ছাড়া উপায় নেই।’ এতে আমার মন খারাপ হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা আপনার পদত্যাগ চাই না। আপনি জাতিকে নির্বাচন দিন, সেটাই চাওয়া।”
এবি পার্টির আহ্বান: সংলাপ ও সমঝোতা প্রয়োজন
আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, “ড. ইউনূসের পদত্যাগের আগ্রহ প্রকাশে জাতির মধ্যে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।” তিনি বলেন, “সমস্যার সমাধান হতে পারে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে। সমঝোতার মাধ্যমে সব পক্ষকে নিয়ে একটি নিরপেক্ষ সমাধানে পৌঁছাতে হবে।”
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী: পদত্যাগ নয়, কাজের গতি দরকার
এদিকে প্রধান উপদেষ্টার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব সামাজিক মাধ্যমে বলেন, “অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ক্ষমতা প্রয়োজন নেই, তবে বাংলাদেশের জন্য তিনি অপরিহার্য।” তিনি বলেন, “সরকারকে আরও বেশি কার্যকর হতে হবে, উপদেষ্টাদের আরও বেশি কাজ করতে হবে, দৃশ্যমান অগ্রগতি জনতার সামনে আনতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে ড. ইউনূসের সম্মান রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আরও নিবিড় আলোচনা ও সংলাপের মাধ্যমে পথ খুঁজে নিতে হবে।”
হাআমা/