কওমি শিক্ষাব্যবস্থার পূর্ণ স্বীকৃতি সময়ের দাবি : জবি অধ্যাপকের মূল্যায়ন

by hsnalmahmud@gmail.com

কওমি শিক্ষাব্যবস্থার কাঠামোগত দুর্বলতা, সনদের সীমাবদ্ধতা ও শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ পথরেখা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ মূল্যায়ন ও গঠনমূলক প্রস্তাব দিয়েছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোঃ ইব্রাহীম খলিল

এক দীর্ঘ ফেসবুক পোস্টে তিনি বলেন, “কওমি আলিমদের মধ্যে অসংখ্য যোগ্য মানুষ রয়েছেন, যারা কেবল কওমি অঙ্গন নয়, বরং পুরো জাতিকে আলোকিত করেছেন। তারপরও পরিস্থিতির কারণে কিছু কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি।”

বিজ্ঞাপন
banner

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত ‘প্রফেশনাল এমএ’ কোর্সের উদাহরণ দিয়ে তিনি তুলে ধরেন, কওমি দাওরায়ে হাদীস সনদধারীরা এই কোর্সে ভর্তি হতে পারছেন না, কারণ তাদের মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক কিংবা স্নাতক পর্যায়ের কোনো স্বীকৃত সনদ নেই। শুধুমাত্র ঘোষণার মাধ্যমে দেওয়া ‘এমএ সমমান’ স্বীকৃতি বাস্তবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কার্যকর নয়।

তিনি লেখেন, “দাওরাহ সনদের স্বীকৃতি থাকলেও সেটা কীভাবে সমন্বিত হবে তার কোনো নির্দেশনা নেই। আর যদি প্রকৃত অর্থে এটি এমএ সমমান হয়, তাহলে আলাদা করে এমএ করার প্রয়োজন কেন?”

একইসঙ্গে তিনি আক্ষেপ করেন, যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতায় কওমি আলিমদের কেউ কেউ এম.ফিল কিংবা পিএইচডি প্রোগ্রামে আবেদনই করতে পারছেন না। অথচ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কওমি সনদের ওপর ভিত্তি করে উচ্চশিক্ষার সুযোগ আছে, যদিও তা খুব সীমিত।

তার ভাষায়,
“আমার খুব প্রিয় একজন কওমি আলিম, গণমাধ্যমে পরিচিত মুখ, যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও আমার তত্ত্বাবধানে এম.ফিলে আবেদন করতে পারেননি। এটা আমাদের জাতীয় ব্যর্থতা।”

তিনি কওমি শিক্ষাব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ স্বীকৃতি ও একটি স্বতন্ত্র কওমি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়ে বলেন,
“কওমি মাদ্রাসার কারিকুলামে প্রাথমিক থেকে উচ্চতর গবেষণার মতো উপাদান রয়েছে। এদের অনুষদে ইসলামি থিওলজি ছাড়াও সাহিত্য, সমাজবিজ্ঞান, ব্যবসা, চিকিৎসা ও প্রকৌশল বিষয় যুক্ত হলে উম্মাহ একজন পরিপূর্ণ মুসলিম শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক, প্রকৌশলী পাবে।”

পোস্টে আরও উল্লেখ করা হয়, কওমি মাদ্রাসাগুলোতে এখনও শিক্ষার্থীদের গড় অধ্যয়নকাল অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে বেশি। কিন্তু সেই মেধা, পরিশ্রম ও অর্জন যদি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে জাতির কল্যাণে ব্যবহার না হয়, তাহলে তা দুর্ভাগ্যজনক।

শেষে তিনি কওমি অঙ্গনের মুরুব্বিদের উদ্দেশ্যে বলেন,
“এই পরিবর্তনের জন্য আন্দোলনের প্রয়োজন নেই, শুধু শীর্ষ অভিভাবকরা উদ্যোগ নিলেই যথাযথ ও সর্বজনগ্রাহ্য কাঠামো তৈরি সম্ভব। কওমি শিক্ষাবিদদের মধ্যেই এমন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সব যোগ্যতা রয়েছে।”

দীর্ঘ স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে ধরা হল : 

কওমি শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে কথা বলার যোগ্য মানুষ আমি না। কওমি আলিমদের মধ্যে অসংখ্য যোগ্য মানুষ রয়েছেন, যারা আপন প্রজ্ঞা ও যোগ্যতায় কেবল কওমি অঙ্গন নয়, বরং পুরো জাতিকে আলোকিত করেছেন। তারপরও পরিস্থিতির কারণে আগে-পরে দু একটি কথা বলেছি। আজও বলছি।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে ‘প্রফেশনাল এমএ’ নামে একটা কোর্স আমরা পরিচালনা করি। বছরে দু বার ভর্তি বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়। যে কোন বিষয় ও বয়সের স্নাতক ও সমমানের ডিগ্রিধারী যে কেউ এই কোর্স ভর্তি হতে পারেন। দু বছর মেয়াদী এ কোর্স ৪টি সেমিস্টারে বিন্যস্ত। এটি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক অনুমোদিত একটি কোর্স, ফলে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ পেয়ে থাকেন।

ইতোমধ্যে ১১টি ব্যাচ ভর্তি হয়েছে, এখন চলছে ১২তম ব্যাচের ভর্তি বিজ্ঞপ্তি, যা জুন মাসের ২৫ তারিখ পর্যন্ত চলবে।

ভর্তির এই বিজ্ঞপ্তিটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে কোর্স পরিচালনা কমিটির কনিষ্ঠসদস্য হিসেবে কওমি ফারেগ ভাইদের অনেকের ফোন আমি পেয়েছি। তাদের একটিই জিজ্ঞাসা, দাওরাহ হাদিস সম্পন্নকারীরা এই কোর্সে অংশ নিতে পারবেন কি না!

আমি দুঃখভারাক্রান্ত কণ্ঠে ‘না’ বাচক জবাব দেই। প্রতিদিনই এই ঘটনা একাধিকবার ঘটে।.

দাওরাহ সম্পন্নকারীরা প্রফেশনাল এমএ কোর্সে ভর্তি হতে পারবেন না কেনো?

-কারণ তাদের মাধ্যমিক/সমমান সার্টিফিকেট নেই

-কারণ তাদের উচ্চ মাধ্যমিক / সমমানের সার্টিফিকেট নেই

কারণ তাদের স্নাতক / সমমানের সার্টিফিকেট নেই

তাদের এমএ-র সমমান সার্টিফিকেটের ঘোষণা আছে। কিন্তু সেটি কীভাবে সমন্বিত হবে তার কোন নির্দেশনা নেই। আবার তাদের যদি সত্যিই এমএ’র সমমান থাকবে তাহলে তাদেরকে আরেকটা এমএ করতে হবে কেনো?

বাস্তবতা হলো, একটি ঘোষণা ব্যতীত দাওরাহ’র এমএ মানের কোনো ভিত্তি নেই, রূপরেখাও নেই। এ কারণে আমার খুবই প্রিয় একজন মানুষ, গণমাধ্যমে ভীষণ জনপ্রিয় মুখ, আমার চেয়ে বেশি যোগ্য হওয়ার পরও আমার তত্ত্বাবধায়নে এম.ফিলে ভর্তির আবেদনই করতে পারেননি।

আমি শুনেছি, দাওরাহ সনদ দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.ফিল / পিএইচডি করা যায়। দু একজন করেছেনও। বলা বাহুল্য, সংখ্যাটি কিন্তু দুই একজন। অসংখ্য নয়। অথচ কওমি আলিমদের অনেকে আলহামদুলিল্লাহ ইলমে-আমলে এমনই উচ্চমান বহন করেন, যদি যথাযথ প্রক্রিয়ায় তাঁরা গবেষণায় নিরত হতে পারতেন, উম্মাহর কল্যাণে তা যুগান্তকারী ভূমিকা রাখতে সক্ষম হতো। আমাদের দুর্ভাগ্য, আমরা তাদের সেবা পাচ্ছি না। তাদের দুর্ভাগ্য, যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কেবল সিস্টেমের কারণে তারা কিছু করতে পারছেন না

অথচ সিস্টেমে সামান্য বদল আনা কি এতোই অসম্ভব?.

কওমি শিক্ষাব্যবস্থার নিজস্ব বোর্ড রয়েছে। অভিন্ন সিলেবাস ও কারিকুলামে তারা লেখাপড়া করান। পৃথিবীর সকল বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো তারাও ডোনেশন গ্রহণ করেন এবং অনেকক্ষেত্রে কেবল ডোনেশন দিয়েই প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন। এর সাথে মাধ্যমিক থেকে স্নাতকোত্তরের স্বীকৃতিটা যদি সংযুক্ত করা সম্ভব হতো, তাহলে কওমি শিক্ষাব্যবস্থা পূর্ণতা পেতো।

আগে-পরে যখন কথা বলেছি, তখন কেউ কেউ বলেছেন, সনদের স্বীকৃতি বা কাজের সুযোগ তৈরি হলে কওমি আলিমরা আর একনিষ্ঠ ইলম চর্চায় থাকবেন না। আলিয়া মাদ্রাসার মতো তারাও দুনিয়ামুখী হয়ে যাবেন।

বাংলাদেশের আলিয়া মাদ্রাসাগুলোকে দৃষ্টান্ত হিসেবে গ্রহণ না করে শত শত বছর ধরে পরিচালিত পৃথিবীর ঐতিহ্যবাহী শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে তাকানো যায়। স্বীকৃতি সেগুলোকে জ্ঞান-গবেষণায় আরও একনিষ্ঠ করেছে। বরং সত্য তো এটাই যে, কোনো ধরনের স্বীকৃতি এবং পার্থিব সচ্ছলতার মাধ্যম না হলে একনিষ্ঠভাবে গবেষণা ও শিক্ষাদান সম্ভব হয় না।

কওমি শিক্ষব্যবস্থার সাথে জড়িতরা হয়তো স্বীকার করবেন না কিন্তু আমার সাধারণ পর্যবেক্ষণেই তো আমি দেখি, কওমি অঙ্গণে আগের মতো খুলুসিয়াতপূর্ণ ইলমচর্চার ধারা অনেক ক্ষেত্রেই আর বিদ্যমান নেই। এর পেছনে অনেক কারণই হয়তো আছে কিন্তু একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ যে, পার্থিব প্রয়োজন পুরণে কওমি শিক্ষার অপ্রাসঙ্গিকতা, সেটা কিন্তু একেবারে মিথ্যা নয়।

কওমি শিক্ষাকে আমরা দুনিয়ামুখী করতে চাই না, ভালো কথা। আখিরাতমুখীই রাখি। কিন্তু আখিরাতমুখী শিক্ষা কি দুনিয়ার সমস্যা সমাধান করবে না? দুনিয়াকে উপেক্ষা করবে? দুনিয়া নিয়ে ভাববে না?

আল্লাহর রাসূল সা.-এর শিক্ষাব্যবস্থা কি এমন ছিল? খুলাফায়ে রাশিদার শিক্ষাব্যবস্থা কি এমন ছিল? উমাইয়া ও আব্বাসি যুগের শিক্ষাব্যবস্থা কি এমন ছিল?

আল্লাহ তো দুনিয়া ও আখিরাত উভয়টির উপর যথাবিধি গুরুত্ব দেয়ার আদেশ করেছেন। রাসূলুল্লাহ সা.-ও দুনিয়াকে উপেক্ষা করার শিক্ষা দেননি। তাহলে কওমি শিক্ষা আখিরাতকেন্দ্রিক দুনিয়ামুখী শিক্ষা হলে অসুবিধা কোথায়?

আমার প্রশ্নগুলো মূর্খতাসুলভ হয়ে গেলে ক্ষমা করবেন। কিন্তু মন থেকে আমি কখনও এই প্রশ্নগুলো দূর করতে পারি না। উম্মাহর অত্যন্ত যোগ্য একদল আলিম, জ্ঞানগত যোগ্যতা থাকার পরও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সর্বজনীন কোনো ভূমিকা রাখতে পারছেন না, এটা মানতে আমার খুবই কষ্ট হচ্ছে এবং হবে।

রাজনীতি নিয়ে আমার কোনো আগ্রহ নেই। সে জন্য এ নিয়ে কখনও কিছু লিখি না বা বলি না। কিন্তু এটা তো সত্য যে, বিগত সরকারের আমলে কওমি আলিমরা একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে ছিলেন আবার বর্তমান পরিবর্তনের সাথেও কওমি অঙ্গণের সুদৃঢ় সম্পর্ক রয়েছে। এতো জায়গায় এতো এতো সংস্কার ও পরিবর্তন এসেছে এবং আসছে।

কওমি অঙ্গণের মুরুব্বিরা বিষয়টি নিয়ে কি ভাবছেন না?

কওমি ধারায় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা আমি অনেকদিন থেকেই বলছি। অধিকাংশ কওমি মাদ্রাসার নাম অবশ্য ‘জামিআ’ – বাংলায় অনুবাদ করলে যা বিশ্ববিদ্যালয়ই বোঝায়। বাস্তবে এটি কেবল একটি নাম। কওমি কারিকুলামে প্রাথমিক থেকে পিএইচডি পর্যন্ত শিক্ষাদান ও গবেষণা করার মতো যথেষ্ট উপাদান রয়েছে এবং এখনও স্বীকৃতিহীনভাবে এই কাজগুলোই করা হচ্ছে। তাহলে স্বীকৃত পন্থায় কাজগুলো করতে অসুবিধা কোথায়?

আমি বিশ্বাস করি, কওমি বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি থিওলজি, লিটারেচার, সোশিওলজি, বিজনেস, মেডিক্যাল ও ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদগুলো চালু হয় তাহলে আমরা সকল ক্ষেত্রে আল-কুরআন, হাদিস ও ফিকহের জ্ঞানের অধিকারী মুখলিস শিক্ষাবিদ, চিকিৎসক ও প্রকৌশলীদের পাবো।

আমার সামান্য অভিজ্ঞতা ও যৎসামান্য জ্ঞান থেকে বলতে পারি, বাংলাদেশের সকল পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রতিদিনের গড় অধ্যয়নকালের চেয়ে এখনও কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের গড় অধ্যয়নকাল বেশি। কিন্তু এই অতিরিক্ত মেহনত যদি শিক্ষার্থীর নিজের, তার পরিবারের এবং জাতির কোনো কাজেই না লাগে, তাহলে এই মেধা, মেহনত ও অর্জনের কী তাৎপর্য?

কওমি শিক্ষাব্যবস্থার সম্মানিত অভিভাবকবৃন্দ! আল্লাহর ওয়াস্তে আপনারা যদি একটু ভাবতেন, তাহলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সাধারণ প্রফেশনাল এমএ করার জন্য বরেণ্য ও লব্ধ প্রতিষ্ঠ কওমি আলিমদের আকুল হতে হতো না।

সময় কিন্তু এখনও আছে। এ জন্য কোনো আন্দোলন-সংগ্রামের প্রয়োজন নেই। কেবল শীর্ষস্থানীয় অভিভাবকবৃন্দ বসে কারিকুলাম তৈরি করে সিদ্ধান্ত নিলেই হয়। কারিকুলাম তৈরি করার জন্য কওমি অঙ্গনেই তো অসংখ্য শিক্ষাবিদ রয়েছেন, যারা উম্মাহর চাহিদা মোতাবেক কালোত্তীর্ণ কারিকুলাম তৈরিতে অত্যন্ত যোগ্য। সবকিছু প্রস্তুত হওয়ার পর প্রয়োজনীয় অনুমোদন আদায় করা কওমি সন্তানদের জন্য কঠিন হবে না, ইনশাআল্লাহ।

একজন নিরপেক্ষ-নির্মোহ পর্যবেক্ষক হিসেবে এ কাজে আমি কওমি সন্তানদের অত্যন্ত সক্ষম মনে করি।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

হাআমা/

banner

এ জাতীয় আরো সংবাদ

প্রকাশক: আবু সায়েম খালেদ
পরিচালক: এইচ. এম. মুহিউদ্দিন খান
আসকান টাওয়ার, ৬ষ্ঠ তলা, ১৭৪ ধোলাইপাড়
যাত্রাবাড়ী, ঢাকা-১২০৪
ইমেইল: info@36news24.com
ফোন: 01401 400222