নুর আলম সিদ্দিকী >>>
তিনি ছিলেন কণ্ঠসৈনিক, ছিলেন সংস্কৃতির এক দীপ্ত শিখা। যিনি গজলের সুরে জাগিয়েছেন হৃদয়, কথার মাধুর্যে ছুঁয়েছেন আত্মা। তিনি ইসলামি সংগীতের কিংবদন্তি মাওলানা আইনুদ্দীন আল আজাদ।
জন্ম ১৯৭৩ সালে, খুলনার ঝিনাইদহ জেলার হাজরাতলা গ্রামে। ছোটবেলা থেকেই রক্ষণশীল পরিবেশে গড়ে ওঠা এই কিশোর শিক্ষা গ্রহণ করেন ছারছীনা মাদরাসা ও ঢাকা আলিয়া থেকে এবং পরবর্তীতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বাংলা সাহিত্যে অনার্স করেন। কিন্তু তিনি শুধু আলেম ছিলেন না—ছিলেন সাংস্কৃতিক জগতের এক বিপ্লবী তারকা।
চরমোনাইয়ের মরহুম পীর মাওলানা ফজলুল করীমের সান্নিধ্যে তিনি আত্মাধাতিকতার পাশাপাশি ইসলামী আন্দোলনের রাজনীতিতে যুক্ত হন। রাজনীতি, আত্মিকতা ও সাংস্কৃতিক সংগ্রামের এই সমন্বয়ই তাকে করে তোলে এক অনন্য নেতৃত্বের দার্শনিক শিল্পী।
পশ্চিমা অপসংস্কৃতির ঢেউ যখন তরুণ সমাজকে গ্রাস করতে শুরু করে, তখন তিনি অনুভব করেন—গান, বাদ্য ও অপসংস্কৃতির আগ্রাসনে কিশোর-তরুণ সমাজ বিপথে যাচ্ছে। তাই গড়ে তোলেন জাতীয় শিশু-কিশোর সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘কলরব’। ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠানটি অল্প সময়েই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সারা দেশে। আজকের জনপ্রিয় ইসলামি সংগীতশিল্পীদের অনেকেই তার হাত ধরেই উঠে এসেছেন। তিনি নিজেও ছিলেন একজন সুরকার, গীতিকার, গায়ক এবং মঞ্চের প্রেরণাদায়ী বক্তা।
মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ছিল তার কণ্ঠে উচ্চারিত প্রতিটি সুরের ভিত্তি। তিনি গেয়েছেন—
“ব্যাথা বুকে আমি গান গাই, কষ্ট ছুঁইয়ে পড়ে তাই,
কষ্টের নদী যে এতই গভীর কূল কিনারা তার নাই।”
তিনি ছিলেন নিপীড়িত মানুষের মুখপাত্র। তার বিপ্লবী গানগুলো আজও চেতনাকে জাগিয়ে তোলে—
“স্বাধীনতা চাইনি আমি এই স্বাধীনতা,
স্বাধীনতা পাইনি আমি সেই স্বাধীনতা…
তাই তো আমি বিদ্রোহী আজ, কথা গুলো বেআইনী।”
দেশপ্রেম তার প্রতিটি সৃষ্টির মূলে ছিল। তার গানে তিনি প্রশ্ন করেছেন—
“রক্তে কেনা বাংলা আমার লাখ শহীদের দান,
তবুও কেন বন্ধু তোমার বিদেশের প্রতি টান?”
প্রতিবাদী সুরে তিনি সমাজের অন্যায়-অবিচারকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন—
“কি হবে বেঁচে থেকে, যদি না গড়ি শোষণ-বিহীন সমাজ?”
আধুনিক অপসংস্কৃতির মোকাবেলায় তরুণদের জন্য গড়েছিলেন ‘কলরব’। তার কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে সংস্কৃতি রক্ষার লড়াই—
“সকাল বেলা পান্থা খেয়ে বৈশাখের ঐদিনে,
বিকেলে আবার উঠছে মেতে ইংলিশ হিন্দি গানে।”
তিনি ছিলেন উদার হৃদয়ের মানুষ। বলতেন—
“আকাশের মত মোর হৃদয়টা কর দাও…”
বন্ধু ও পরকালের ভাবনায় ভরপুর গানেও তিনি ছিলেন অনন্য—
“পদ্মা-মেঘনা যমুনার তীরে, কত ঢেউ চলে যায় আসে না তো ফিরে…”
“বন্ধু ভুলে যেওনা কখনো…”
সবশেষে, “রঙিন এই পৃথিবী ছাড়িতে হবে, স্বাদের এই দেহ মাটিতে খাইবে। শূন্য হবে জিন্দেগানী” সঙ্গীতটি রেকর্ড শেষ করার পূর্বেই ২০১০ সালের ১৮ জুন নাটোরের লালপুরে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি ইন্তেকাল করেন। রেখে যান স্ত্রী, এক পুত্র ও এক কন্যাসহ অগণিত গুণগ্রাহী ও ভক্ত।
আইনুদ্দীন আল আজাদ গানের মাধ্যমে সমাজের বিবেক জাগিয়ে তুলেছিলেন। তার কণ্ঠে ছিলো বঞ্চিত মানুষের আর্তনাদ, তার গানে ছিলো অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। মৃত্যুর পরেও তার গজলগুলো আজও বাজে মানুষের হৃদয়ে, ঘরে, মঞ্চে—আত্মশুদ্ধির বার্তা নিয়ে। তিনি প্রমাণ করে গেছেন—গান শুধু বিনোদন নয় বরং এক শক্তিশালী বিপ্লবের ভাষাও হতে পারে।
এনএ/