হামিদ মীর >>
আপনার চারপাশে তাকান। ঘৃণা ছড়িয়ে পড়ছে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে। ভালোবাসা ও বন্ধুত্ব এখন আমাদের ব্যক্তিগত স্বার্থের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ভালোবাসা ও বন্ধুত্ব ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। ঘৃণা ব্যবসার একটি মাধ্যম, ভালোবাসাও এখন একটি ব্যবসা হয়ে উঠেছে। এ ব্যবসা শুধু আমাদের আশপাশে নয়, বরং এটি একটি আন্তর্জাতিক আকর্ষণের বিষয় হয়ে গেছে। ইউরোপে-আমেরিকায় ইসলামবিদ্বেষ একটি ইন্ডাস্ট্রিতে পরিণত হয়েছে।
আমেরিকা-ইউরোপ এখন নিজেদের মধ্যে সংঘাতে লিপ্ত। একই সাথে মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা। অন্যদিকে মুসলমানরা নিজেরা একে অপরকে হত্যা করছে। কেউ কেউ আমেরিকা ও ইউরোপে ইসলাম প্রতিষ্ঠার বাসনা পোষণ করে। তবে তারা ইসলাম প্রতিষ্ঠার সুন্দর পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারছে না। পাশ্চাত্যে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানোর সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে সেসব মুসলমান, যারা অগ্রহণযোগ্য উপায়ে মানুষকে কষ্ট দিয়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে চায়। অপরদিকে মুসলিম দেশগুলোতে পশ্চিমা বিরোধিতার সবচেয়ে বড় শক্তি হলো সেসব পশ্চিমা উগ্রবাদী সন্ত্রাসী, যারা কখনো কোরআন পোড়ানোর ঘোষণা দেন, আবার কখনো ইসলামবিরোধী বই লিখে অর্থ উপার্জন করেন, যেমন টেরি জন নামের মার্কিন যাজক।
আমেরিকা-ইউরোপে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণামূলক অপরাধ আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। কিছুদিন আগে লন্ডনে তুর্কি দূতাবাসের সামনে কোরআন শরীফ পোড়ানোর চেষ্টা এমনই একটি ঘটনা। ইউরোপে ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো শক্তিশালী হচ্ছে, যারা মুসলমানসহ এশিয়া ও আফ্রিকা থেকে আগত মানুষদের নিজেদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দিতে চায়। গভীরভাবে ভাবনার বিষয় হলো, ভ্যাটিকান ও মিশরের আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আন্তঃধর্মীয় সংলাপ বহু বছর ধরে চলছে, তবুও পাশ্চাত্যে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা কমছে না। কোরআন ও মহানবী হজরত মুহাম্মদ সা. এর অবমাননার ঘটনা ক্রমাগত ঘটে চলেছে।
সাধারণ একটি ধারণা হলো, ইসলাম অবমাননার ঘটনাগুলো ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকায় আল-কায়েদার হামলার প্রতিবাদস্বরূপ ঘটছে। এটা বড় একটি ভুল ধারণা। পাশ্চাত্যে কোরআন অবমাননা ও নবী অবমাননার ইতিহাস বহু পুরনো। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক প্রফেসর আব্দুর রহিম কিদওয়াই ‘ইংরেজি সাহিত্যে রাসূল সা. এর অবস্থান’ নিয়ে একটি বিশ্লেষণমূলক গবেষণা করেছেন। গবেষণায় তিনি জানিয়েছেন, ১৬৪৯ সালে আলেকজান্ডার রস কোরআনের প্রথম ইংরেজি অনুবাদ করেন এবং তাতে অনেক মিথ্যা তথ্য সংযোজন করে ইসলামকে কলঙ্কিত করার অপচেষ্টা করেন। পরে ফরাসি সাহিত্যিক ভলতেয়ার ও শেক্সপিয়ারও নিজেদের লেখায় নবী করিম সা. এর অবমাননা করেছেন। কিন্তু জার্মান সাহিত্যিক গ্যেটে এবং ব্রিটিশ সাহিত্যিক টমাস কার্লাইল ইসলাম ও নবী মুহাম্মদ সা. এর বিরুদ্ধে তাদের মিথ্যা প্রচার প্রত্যাখ্যান করে কলম ধরেন। কার্লাইল নবী মুহাম্মদ সা. কে একজন আদর্শ পুরুষ হিসেবে তুলে ধরেন। এরপর আমেরিকান বিজ্ঞানী মাইকেল হার্ট, জার্মান ইতিহাসবিদ আন্নে ম্যারি শিমেল এবং ব্রিটিশ লেখিকা কারেন আর্মস্ট্রংসহ আরও অনেক পশ্চিমা চিন্তাবিদ রাসূল সা. এর সত্যতা ও শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করেছেন।
প্রফেসর কিদওয়াই ছাড়াও সৌদি আরবের বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ প্রফেসর ড. আব্দুল আজিজ বিন ইবরাহিম আল-উমরী তার বই ‘রাসূলুল্লাহ ও খাতামুন নাবিয়িন’ তে বার্নার্ড শ’সহ বহু পশ্চিমা লেখকের কথা উল্লেখ করেছেন, যারা হজরত মুহাম্মদ সা. কে বিশ্ব শান্তির অগ্রদূত হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি দীর্ঘ গবেষণা করে খ্রিস্টান ও ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে রাসূল সা. এর সত্যতা তুলে ধরেছেন। এসব প্রমাণ করে, আমাদের শেষনবী মুহাম্মদ সা. বহু শতাব্দী ধরে ‘ফেক নিউজ ও তথ্য সন্ত্রাসের’ শিকার হয়ে এসেছেন।
আজ যখন আমেরিকায় রবার্ট স্পেনসার ইসলামবিরোধী বই লেখেন বা ডাচ রাজনীতিবিদ গির্ট উইল্ডার ইসলামবিদ্বেষী সিনেমা প্রকাশ করেন, তখন আমরা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করি। প্রতিবাদ অবশ্যই করা উচিত, কিন্তু একই সাথে আমাদের করণীয় হলো, কার্লাইল ও মাইকেল হার্টের মতো পশ্চিমা চিন্তাবিদদের কথা উল্লেখ করা, যারা মহানবী সা. এর বিরুদ্ধে পশ্চিমা লেখকদের মিথ্যা অপবাদ জোরালোভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন। ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানো রোধে জ্ঞান ও গবেষণার মাধ্যমে কাজ করা অনেক বেশি কার্যকর হতে পারে।
মহানবী সা. এর পবিত্রতা ও সত্যতার বিষয়টি শুধু পশ্চিমে নয়, পূর্বের অনেক হিন্দু ও শিখ লেখকও স্বীকার করেছেন। সংস্কৃতের বিখ্যাত পণ্ডিত এবং এলাহবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পণ্ডিত বেদ প্রকাশ উপাধ্যায় তার বই ‘কল্কি অবতার ও হজরত মুহাম্মদ সা.’ তে দাবি করেছেন, হিন্দু ধর্মগ্রন্থে ‘কল্কি অবতারের’ যে বর্ণনা রয়েছে, তা মূলত শেষনবী মুহাম্মদ সা. কে বোঝায়। উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা প্রায়ই কোরআন ও ইসলাম সম্পর্কে কটূক্তি করে, কিন্তু খুব কম মুসলমান আছেন যারা হিন্দু লেখকদের স্বীকৃতিকে ইসলামপন্থায় উপস্থাপন করতে পারেন। মুসলমানদের যুক্তি অনেক শক্তিশালী, কিন্তু সেই যুক্তি তুলে ধরতে হলে সহিংসতার পথ গ্রহণ করা সঠিক পন্থা নয়। সহিংসতা শত্রুদের উদ্দেশ্য পূরণের কাজে সাহায্য করে থাকে।
কোরআন বলেছে, ‘হে ঈমানদারগণ! আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাকো।’ সত্যের সাথে থাকা কঠিন, কিন্তু শেষ বিজয় সর্বদা সত্যেরই হয়ে থাকে। মুসলমানদের উচিত উত্তম চরিত্র দিয়ে নিজেদের ধর্মের সত্যতা প্রমাণ করা। কোরআন ন্যায়বিচারের আদেশ দেয়, বিশেষত লেনদেনে। আমরা কি একে অপরের সঙ্গে ন্যায্য ব্যবহার করি? ইসলাম মিথ্যা বলতে, অপরকে উপহাস করতে, কটু কথা বলতে, অন্যায়-অবিচার এবং অঙ্গীকার ভঙ্গ করতে নিষেধ করে। আমরা কি এসব শিক্ষার প্রতি অনুগত? যখন আমরা নিজেদের সাথেই সুবিচার করি না, তখন কীভাবে আমাদের ধর্মীয় বিষয় রক্ষা করবো?
প্রথমে আমাদের নিজেদের মধ্যে ঘৃণা কমাতে হবে, তাহলে আমরা বাইরের ঘৃণা মোকাবেলা করতে পারবো। আমরা ইসলামকে সত্য ধর্ম বলি, কিন্তু সে সত্যের পথে আমাদের অবস্থান কতটা? যদি আমরা চাই আমাদের ধর্ম সম্পর্কে মিথ্যা না বলা হোক, আমাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা না ছড়ানো হোক, তাহলে আমাদের এমন চরিত্র গঠন করতে হবে, যেন আমাদের শত্রুরা অন্তত এতটুকু স্বীকার করতে বাধ্য হয়, আজকের মুসলমানরা সত্যিই সে নবীর অনুসারী, যিনি ‘সাদিক’ ও ‘আমিন’ নামে পরিচিত ছিলেন। যে মুসলমান সত্য পথে চলে না, আমানতের খিয়ানত করে, তাকে কি সত্যিই মুসলমান বলা যায়? পশ্চিমে বড়দিন আসলে পণ্যের দাম কমে যায়, আর আমরা রমজানে একে অপরকে ঠকাই। যেদিন আমরা একে অপরকে ঠকানো বন্ধ করব, সেদিনই পাশ্চাত্যে কোরআন ও নবী অবমাননাও বন্ধ হয়ে যাবে।
‘ডেইলি জং-এ প্রকাশিত প্রখ্যাত পাকিস্তানি সাংবাদিকের
কলাম থেকে অনুবাদ আমিরুল ইসলাম লুকমান
এআইএল/