হাসান আল মাহমুদ >>
সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত নারীমৈত্রীর একটি সমাবেশে চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চল থেকে সেনা প্রত্যাহারের দাবিতে প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করা হয়। বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও বিশ্লেষক মহলে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। অনেকে প্রশ্ন তুলছেন—সেনাবাহিনী মোতায়েনের যৌক্তিকতা যেখানে দেশের সার্বভৌমত্ব, নিরাপত্তা ও অখণ্ডতার প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ, সেখানে এমন দাবি কতটা দায়িত্বশীল, আর কার স্বার্থকে প্রতিনিধিত্ব করে?
সেনাবাহিনীর পাহাড়ে অবস্থান: প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল দীর্ঘদিন ধরে জাতিগত বৈচিত্র্য, নিরাপত্তা সমস্যা, এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতার কারণে বিশেষ নজরদারির আওতায় রয়েছে। ১৯৯৭ সালের পার্বত্য শান্তি চুক্তির মাধ্যমে অনেক উত্তেজনা প্রশমিত হলেও এখনো sporadic (বিচ্ছিন্ন) সন্ত্রাসী কার্যক্রম, চাঁদাবাজি, অস্ত্র ব্যবসা, এবং রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব এই অঞ্চলে বিদ্যমান।
এই প্রেক্ষাপটে, সেনাবাহিনীর উপস্থিতি সুশৃঙ্খল অবকাঠামো উন্নয়ন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা এবং বিদেশি আগ্রহ ও হস্তক্ষেপ প্রতিরোধে একটি কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে বলে অনেক বিশ্লেষকের মত।
নারীমৈত্রীর দাবি: মত প্রকাশ না, না কি ‘সুক্ষ্ম উদ্দেশ্য’?
নারীমৈত্রীর মতো একটি সংগঠন, যারা নারীর অধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচারের কথা বলে, তাদের পক্ষ থেকে পাহাড়ে সেনা মোতায়েনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া অনেকের জন্য বিস্ময়কর। কেননা এটি সরাসরি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার ইস্যু—যা জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত।
বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করেন, বাম রাজনৈতিক আদর্শে অনুপ্রাণিত কিছু সংগঠন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের ছায়ায় এমন দাবিকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়, যা শেষ পর্যন্ত দেশি-বিদেশি বিচ্ছিন্নতাবাদী এজেন্ডার উপকারে আসতে পারে।
এদিকে বিষয়টি নিয়ে জাতীয় পরিসরে শুরু হয়েছে ব্যাপক আলোচনা ও বিতর্ক। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন—এমন একটি স্পর্শকাতর ইস্যুতে অবস্থান নিয়ে নারীমৈত্রী আসলে কার স্বার্থ রক্ষা করছে?
দেশের আপামর জনতা মনে করছেন, দেশের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি একটি সময়োপযোগী ও কৌশলগত পদক্ষেপ। ১৯৯৭ সালের শান্তি চুক্তির পরও পাহাড়ি অঞ্চলে এখনও বিচ্ছিন্নতাবাদ, সশস্ত্র সংঘর্ষ, চাঁদাবাজি ও নিরাপত্তাহীনতার চিত্র সম্পূর্ণরূপে দূর হয়নি। এই প্রেক্ষাপটে সেনাবাহিনী শুধু নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করছে না, বরং সেতু, সড়ক ও স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নের মাধ্যমেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে।
এমন বাস্তবতায় সেনা প্রত্যাহারের দাবি কেবল প্রশ্নবিদ্ধই নয়, বরং অনেকের দৃষ্টিতে তা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা কাঠামোর বিরুদ্ধে এক ধরনের অদৃশ্য চাপ তৈরির প্রয়াস। বিশেষ করে যখন ওই দাবি এমন একটি সংগঠনের পক্ষ থেকে আসে, যারা নারী অধিকারের ব্যানারে কাজ করে থাকে।
প্রশ্ন ওঠে: কী উদ্দেশ্যে এমন দাবি?
১. বিদেশি এনজিও বা মহলের চাপে এমন দাবি কি উত্থাপিত হচ্ছে?
২. জাতীয় সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করে কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের চেষ্টা হচ্ছে কি?
৩. সাংবিধানিক কাঠামোর বাইরে গিয়ে পার্বত্য অঞ্চলকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়ার আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ কি এমন প্রচার?
রাষ্ট্র ও জনমতের ভূমিকা
একটি স্বাধীন দেশের সেনাবাহিনী যখন দেশের সীমান্তে, বা অস্থিতিশীল অঞ্চলে মোতায়েন থাকে, তা জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থেই। এমন অবস্থায় যারা সেনা অপসারণের কথা বলে, তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য কী—তা নিয়ে জাতীয়ভাবে প্রশ্ন তোলা ও বিশ্লেষণ প্রয়োজন।
মতপ্রকাশের অধিকার অবশ্যই সাংবিধানিক, তবে সেটা যেন জাতীয় স্বার্থ ও নিরাপত্তার বিরুদ্ধে না যায়, সেই বোধ প্রতিটি নাগরিক ও সংগঠনের থাকা জরুরি।
সমালোচকরা বলছেন, “সেনা অপসারণের মতো জাতীয় নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট ইস্যুতে বামপন্থী আদর্শে অনুপ্রাণিত একটি সংগঠনের এমন অবস্থান সরল মনে নেওয়া যায় না। এটা কি কোনও আন্তর্জাতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের অংশ? নাকি দেশের ভিতরে একটি নির্দিষ্ট মহলের প্রচ্ছন্ন মদদে এই দাবি তোলা হচ্ছে?”
সরকারি মহলে এ বিষয়ে এখনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া না এলেও, সচেতন নাগরিক সমাজ মনে করছে—জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে যেকোনো মন্তব্য বা দাবি করার আগে দায়িত্বশীলতা ও যথাযথ প্রেক্ষাপট বোঝা জরুরি।
বিশেষ দ্রষ্ট্রব্য : নারীমৈত্রীর মতো সংগঠনের এমন বিতর্কিত দাবির পেছনে উদ্দেশ্য ও প্রভাব নিয়ে স্বচ্ছ বিশ্লেষণ প্রয়োজন। সেনাবাহিনী শুধু একটি বাহিনী নয়, এটি একটি রাষ্ট্রীয় প্রতীক—যার অবমূল্যায়ন কোনোভাবেই মঙ্গলজনক নয়, বিশেষত যখন তা আসে একটি ভূ-রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল এলাকা থেকে।
হাআমা/