ফিলিস্তিনের জন্য একগুচ্ছ কবিতা

by Kausar Labib

নির্বিবেক পৃথিবীর ওপর এ কার পতাকা

আল মাহমুদ

বিজ্ঞাপন
banner

আমাদের দেহের ওপর শত্রুর প্রতিটি অস্ত্রাঘাতই তোমার চেনা। কারণ

প্রতিটি আঘাতই সামনের দিকে। বর্তমান জগতের সবগুলো যুদ্ধক্ষেত্রেই তো

আমি ছিলাম। ছিলাম নাকি? ভুরুর ওপরের এই কাটা চিহ্নটি তোমার এমন

পছন্দ, জানো কি একটি গ্রেনেডের স্প্লিন্টারে।

রক্তাক্ত হয়ে যখন লুটিয়ে পড়েছিলাম কারগিলে। মৃত্যুর

অন্ধকারে বেহুঁশ হয়েও অবচেতনার এলোমেলো স্বপ্নে তোমার কাছেই

ফিরে আসার সাঁতার। ভাবো সেই আকুলিবিকুলি।

এখন আগানিস্তান থেকে সঞ্চিত ক্ষতচিহ্নগুলো কি তোমাকে ভয়

ধরিয়ে দিয়েছে? অথচ

আমার পৃষ্ঠদেশে তুমি সারারাত হাতড়েও একটি কাপুরুষতার ক্ষত বের

করতে পারোনি। এবার চুম্বন কর আমার প্রতিটি আঘাতের চিহ্নে, কারণ

পৃথিবীর প্রতিটি রণক্ষেত্রে আমি ভীরুতা, শান্তি ও আত্মসমর্পণের

বিরুদ্ধে লড়ে এসেছি এবং জেহাদের মহিমা প্রচার করেছি। তোমার

উষ্ণ ওষ্ঠের এক সহস্র চুম্বন আমার প্রাপ্য, দাও

ঋণশোধ করে। কে জানে এবার যদি ফিলিস্তিন থেকে আমার আর

ফেরা না হয়? তুমি তো দেখবে না হেবরণের কোনো ধূলিধূসরিত

কান্তারে পড়ে আছে এক শহীদের রক্তে ভেসে যাওয়া

চেহারা, মুখ থুবড়ে। কিন্তু পিঠে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই।

কিংবা আল আকসার আঙিনায় হুমড়ি খেয়ে শিশুর মত পড়ে আছে

এক বিজয়ী বীর যার প্রতিটি ক্ষতস্থান থেকে রক্তের বদলে

বেরিয়ে আসছে যুদ্ধের চিকার। আর জেহাদ জেহাদ শব্দে তার

আকুতি ছড়িয়ে পড়ছে পৃথিবীতে।

 

বলো তুমি আর আমি ছাড়া কে আর পৃথিবীতে যুদ্ধ চায়? অধর্মের

বিরুদ্ধে এই হল মানবতার শেষ জেহাদ। আমরা কি আল্লার জমিনে

জানোয়ারের রাজত্ব কায়েমে বাধা দেব না? আমার বাম পাঁজরে

আফগান যুদ্ধের সহস্র বোমার বিধ্বংসী ক্ষতচিহ্ন। তবে কি আমরা

যুদ্ধ ছেড়ে দেব? না, আমাদের নিঃস্তব্ধতা ও মৃত্যুর ভেতর থেকে

জন্ম নিচ্ছে নতুন কবিতা। যুদ্ধের কবিতা। না প্রেম, না শান্তি।

 

ভাবো, যুদ্ধ ছাড়া ভালো মানুষের আর বাঁচার উপায় রইল না। তোমার

সিজদার জায়গা কোথায়? তোমার কেবলা কোন দিকে?

কবিরা শিল্পীরা কেন এত ভালোবাসার কথা বলে, কেন বলে?

তারা কি মার্কিন বোমার হাত থেকে তাদের আধ্যাত্মিক ঐশ্বর্য রক্ষা করতে সক্ষম?

ভালোবাসা, তোমার ওপর নাপাম বোমা।

প্রেমপ্রীতি মনুষ্যত্ব তোমাদের ওপর কার্পেট বম্বিং

মসজিদ মাদ্রাসা সবকিছুর ওপর বোমা। বোমা, নারী শিশু মাতৃউদর।

শিল্প-সাহিত্য রুচি-সভ্যতা—দ্রুম, দ্রুম, দ্রুম।

 

এরপর একটাই দৃশ্য দেখতে বাকি, নিপ্রাণ চাঁদের ওপর

যেমন মার্কিন পতাকা, তেমনি নির্বিবেক পৃথিবীর ওপর

পরাজিত পৃথিবীর ওপর একটি বিশাল

মার্কিন পতাকা।

 

ফিলিস্তিনি শহিদ শিশু-কন্যাকে

আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ

 

তোমাকে নিয়ে কবিতা লেখার কোনো কথাই ছিলো না।

হে রক্তগোলাপ- জান্নাতের ফুল। তোমাকে আমি জানতামই না!

দেখো- আজ সবুজ কাফন কীভাবে তোমাকে আপন করে তুলছে।

যেন মত্যুই একমাত্র পাসপোর্ট আমাদের সীমানা ভাঙ্গার!

যেন এই শবমিছিল আমাদের এক হয়ে যাওয়ার রাস্তা।

আমি হাইফা থেকে জাফফা হয়ে, মসজিদুল আল আকসার

সোনালি গম্বুজে তোমাকে খুঁজছি। তোমাকে খুঁজছি জেরুজালেমে –

তোমার দাদাজানের হারানো বসত বাটিতে।

তোমাকে খুঁজছি হেবরনে- তোমার আব্বার ওলিভ বাগানে।

বানু কুরাইজা হয়ে অহংকারী যায়নবাদীদের শ্যান দষ্টি  থেকে

তোমাকে বাঁচিয়ে রেখেছি- সিনাইয়ের মালভূমিতে।

ওরা তোমাদের ঘরবাড়ি ছিনিয়ে নিয়েছে কত আগে। আহা!

ওরা তোমার ভাই আর বাবাকে স্নাইপারের বলি বানিয়েছে।

রক্তপিপাসু, অভিশপ্ত দখলদার বাহিনীর নিশানা হওয়ার আগে  তুমি কি

পুতুল নিয়ে খেলছিলে বন্ধুদের সাথে? মাটিতে পড়ে যাওয়ার সময়-

তুমি কি দেখছিলে স্বাধীন পতাকা হাতে দৌড়ে আসছে-

লাখো মরিয়ম, রাওয়া, আয়মান, মোহাম্মদ আর আবদুল্লাহ!

এখন একটু ঘুমিয়ে থাকো হে আমার সন্তান।

যতক্ষণ না পর্যন্ত মুসলিম মিল্লাত- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র ব্যনারে

এক না হচ্ছে। যতক্ষণ না পর্যন্ত মরু ময়দানে- ওমর বিন খাত্তাব,

খালিদ বিন ওয়ালিদ, আবু উবাইদা, সালাউদ্দিন আইয়ুবীর জন্ম না হচ্ছে।

ততক্ষণ পর্যন্ত শান্তিতে ঘুমিয়ে থাকো- হে জান্নাতের ফুল।

 

ফাদি আবু সালাহ্

লতিফুল ইসলাম শিবলী

 

তোমাকে দেখার আগে

জানা ছিল না—

মানুষের পা কেড়ে নিলে

তার পিঠে গজায় ডানা,

আর হাঁটতে বাধা দিলে মানুষ শিখে যায় উড়তে।

 

ওরা শুরু করেছিল তোমার পায়ের নিচের মাটি থেকে,

তাই প্রথমে ওরা কেড়ে নিয়েছে তোমার জমিন।

দেশ নামের যে এক চিলতে জেলখানায় তুমি থাকতে

সে জমিন শত শত শহিদের ভিড়ে কবেই হয়ে গেছে মর্ত্যের জান্নাত।

 

এরপর ওরা কেড়ে নিয়েছে তোমার শৈশব—

অথচ তুমি কখনোই শিশু ছিলে না,

তুমি ছিলে সেই জান্নাতের সবুজ আবাবিল।

আব্রাহার হস্তি বাহিনীর উপর কঙ্কর ছুড়ে

যেভাবে তছনছ করে দিয়েছিল

আজ তাবৎ পৃথিবী জানে তুমিই সেই আবাবিল,

একই কায়দায় ছুড়ে মারো কঙ্কর

আব্রামস ব্যাটেল ট্যাঙ্কের দিকে।

 

তোমাকে তো ছেড়ে দেয়া যায় না—

এরপর ওরা কেড়ে নিলো তোমার তারুণ্য,

তোমাকে জেলে পুরে ওরা ভেবেছিল

শুকনা পাতার নিচে ওরা লুকিয়ে রাখবে আগুন।

আটলান্টিকের এপার ওপার হয়ে

সে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে সাতটি সাগর-মহাসাগরের কূলে উপকূলে।

 

আর তোমার দৃপ্ত পদভারে যখন কেঁপে কেঁপে উঠতে শুরু করেছে

জেরুজালেমের প্রাচীন দেয়াল,

ঠিক তখনি ওরা কেড়ে নিয়েছে

তোমার অনিন্দ্য সুন্দর পা জোড়া।

 

সাধ্য আছে কার,

কীভাবে থামাবে ওরা তোমার চার চাকার হুইল চেয়ার!

ওরা জানত হুইল চেয়ারে বসেও বৃদ্ধ ইমাম শেখ ইয়াসিন

ছিলেন কতটা অপ্রতিরোধ্য—

সেই বৃদ্ধকে হত্যা করতে যারা হেলিকপ্টার গানশিপ থেকে মিজাইল ছুড়তে পারে,

তারা তোমার এই উদ্ধত যৌবনের কাছে কেমন অসহায় কাপুরুষ।

 

ওরা জানে তোমার প্রাণশক্তির উৎস,

ওরা জানে এই ফিলিস্তিনের মাটিতেই ডেভিডের ছোড়া

ঢিলের আঘাতে কীভাবে পরাজিত হয়েছে জালিম গোলিয়াথ।

 

হে ফাদি আবু সালাহ্

হে পাথর ছোড়া আবাবিল—

তাই আজ ওরা কেড়ে নিলো তোমার জীবন।

আহা, জান্নাতের সবুজ পাখি

তোমাকে দেখার আগে জানা ছিল না

পা’হীন মানুষের পিঠে গজায় এমন উড়াল ডানা।

 

আমরা জানি, ঠোঁটে কঙ্কর নিয়ে তুমি ফিরে আসবে বলেই

দিয়েছ এই উজাড় উড়াল।

আমরা প্রতীক্ষায় আছি—

ঝাঁকে ঝাঁকে ফিরে আসো আবাবিল

ঝাঁকে ঝাঁকে, ঝাঁকে ঝাঁকে…

 

পবিত্রভূমি

হিজল জোবায়ের

 

প্রথমে নারীদের হত্যা করা হবে

যাতে নতুন কোনো শিশুর জন্ম না হয়;

ভবিষ্যত বলে কিছু না থাকে ওদের।

 

তারপর জীবন্ত শিশুদের,

যাতে হারিয়ে যায় নিকট ভবিষ্যতও

 

তারপর সক্ষম যুবক আর পুরুষদের;

বয়স্কদের হত্যা করা হবে না।

অন্যদের মেরে শেষ করতে যেটুকু সময়

বয়স্করা ততক্ষণে আপনাতেই মারা যাবে;

 

আর আমরা পাবো একটা স্বাধীন ফিলিস্তিন,

গ্যাস-চেম্বার থেকে বেরিয়ে আসা ইসরাইলের জন্য।

 

লাব্বাইক লাব্বাইক ইয়া আকসা লাব্বাইক

হাসান রোবায়েত

 

তোমার জলপাইবাগানের মধ্যে শতবর্ষের ঝরে যাওয়া পাতা, দূরে ক্রীড়ারত শিশুদের মুখে আপেল ফুলের সৌরভ আমি অনুভব করতে পারি এই ধূলিধূসরিত সবুজ বাঙলার কোনো এক জলাঙ্গীর ধারে বসে—যেখানে আকাশ নীল, সমুদ্র ও ঝাউবনের ঢেউগুণ্ঠন উপচে পড়ছে বেলায়—তোমার কান্নারত শিশুদের শরীরের রক্ত টিসু দিয়ে মুছতে মুছতে আমি হাজির হই তোমার পাশে হে আকসা, হে প্রিয়তম রসুলের জায়নামাজ বহনকারী আকসা, তোমার জলপাই বাগানের মধ্য দিয়ে যে তরুণী হেঁটে গেছে তার তরুণের জন্য আমি তার ইশকের সাক্ষ্য হয়ে হাজির হয়েছি—

 

লাব্বাইক লাব্বাইক ইয়া আকসা লাব্বাইক

লাব্বাইক লাব্বাইক ইয়া আকসা লাব্বাইক

লাব্বাইক লাব্বাইক ইয়া আকসা লাব্বাইক

 

ক্রিসানথিমামের ফুলগুলো যখন জান্নাতের দিকে উড়ে যায় আমার চোখে তখন বস্তুপৃথিবীর ক্রন্দন কেমন হাহাকার করে ওঠে—যেন আমার পদ্মা-যমুনা-ধলেশ্বরীতে লাশের বেদনায় কেঁপে কেঁপে উঠছে মুহুর্মুহু—তৃণপ্রান্তর, নদীখাত বাতাসের গোল গোল চাকা গড়িয়ে পড়ছে অজস্র রক্তের উপর—শহীদের মায়েরা সবুজ গম্বুজের দিকে তাকিয়ে সোনালি গমের প্রান্তরের মতো তাকিয়ে আছে আল্লার আরশের দিকে এমন সময় যখন হসপিটালের পলেস্তরাতেও ধরে গেছে আলেকজান্দ্রিয়ার আগুন তখন হে আকসা, হে আমার প্রাণের জলপাইকুঞ্জের গান আমি তোমার জন্য হাজির হয়েছি এই অক্টোবরের নৈঃশব্দ-রচিত অপার্থিব শূন্যতায়—

 

লাব্বাইক লাব্বাইক ইয়া আকসা লাব্বাইক

লাব্বাইক লাব্বাইক ইয়া আকসা লাব্বাইক

লাব্বাইক লাব্বাইক ইয়া আকসা লাব্বাইক

 

প্রেমের গানের চাইতে আরও বেশি দ্বিধান্বিত শূন্যতায় যখন আমার জন্মভূমি বাকশাল-বিরচিত, যখন গুম হওয়া লাশের জন্য কন্যারা চুল খুলে দাঁড়িয়েছে হেমন্তের পত্রঝরের মতো তখন আমার ভাইয়েরা বোনেরা মা ও শিশুরা পরস্পরের রক্ত মোছার বাহানায় দুনিয়ার সমস্ত মর্মরের ধ্বনিকে ধারণ করছে বুকের ভিতর, তখন আমার ইন্দ্রিয়ময়তায় কেবলই ঝাপটা লাগছে তোমার অলিভপাতার যেন আমি এক প্রাজ্ঞ মুসাফির দুনিয়ার সমস্ত শহর হেঁটে আস্তানা গড়েছি এই আকসায়—হে আকসা আমি যেন হাজির হয়েছি পপলার আর ওক গাছ পেরিয়ে কেবল জলপাইকুঞ্জের দিকে—আমাকে কবুল করো হে আকসা—

 

লাব্বাইক লাব্বাইক ইয়া আকসা লাব্বাইক

লাব্বাইক লাব্বাইক ইয়া আকসা লাব্বাইক

লাব্বাইক লাব্বাইক ইয়া আকসা লাব্বাইক

 

ইনতিফাদা…ইনতিফাদা

মাঈন উদ্দিন জাহেদ

 

স্বাধীনতা শব্দটি দ্রোহের আকর হয়ে বুকে জ্বলছিলো যাঁদের ,

কৈশোর পেরিয়ে বেদনার রক্তে গড়েছিলো যে খণ্ডিত পায়ে

জীবন্ত শহীদ ভাস্কর্য যারা

তারুণ্যে মুহুর্মুহু স্লোগান… ইনতিফাদা… ইনতিফাদা…

পাথরে পাথর জ্বেলে বুকে জ্বেলে আগুন

ফিলিস্তিন মানচিত্রে রচে যায় সাহসী ফাগুন ৷

মারগারে আমেরিকা… মার… মার…

মারগারে ইসরাইল… মার…. মার…

ইনতিফাদা… ইনতিফাদা…

রক্ত ও বারুদে মেশানো ফাদি আবু সালাহ্’র ভাইয়েরা!

বেহেস্তের এক একটি অনাঘ্রাণ পুষ্প…

তোমার আমার প্রাণের দামে হবে বিজয়ী ফিলিস্তিন।

শান্তি বাণিজ্যের নেমক হারাম সওদাগর- জাতিসংঘ!

হায়, তার সদরদপ্তরে গিয়ে একবার যদি পেচ্ছাব করতে পারতাম!

ফাদি আবু সালাহ্! তোমাকে সালাম!

আমার শহীদ ফিলিস্তিনী ভাইয়েরা! তোমাদের  সালাম।

সালাম ইয়া আইয়ুহাল মাহদী… সালাম…

সমগ্র উম্মার সালাম…

নোমান প্রধান

আজ পৃথিবী নিজেই পরবাসী

 

লাল-সবুজ-আধার-আলো; চাররঙা পতাকার উপর বৃষ্টি হচ্ছে।

 

বৃষ্টি হচ্ছে তপ্ত সীসা, বারুদ আর আগুনের

বৃষ্টি হচ্ছে পশ্চিমের অভিজাত আগ্রাসনের

বৃষ্টি হচ্ছে অত্যাধুনিক বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের

বৃষ্টি হচ্ছে ভালোবাসার বিরুদ্ধে শুধুই ঘৃণার।

 

মুষল সেই ধারাপাতে মরনাস্ত্রের চেয়ে ভয়ংকর হয়ে উঠেছে দেমাগ।

 

দেমাগ তার ফুলে ফেপে উঠা অর্থরাজির

দেমাগ তার অফুরন্ত ক্ষমতা বোমাবাজির

দেমাগ তার বন্ধু সাত সাগরের শ্বেতাঙ্গের

দেমাগ তার প্রিয় পোষমানা জাতিসংঘের।

 

তারা জানে- মুক্তিকামী মানেই সূর্য্যসেন, সূর্যসেন মানে অমর ফেরারী।

 

তারা স্বাধীনতার সংগ্রামকে বলে সন্ত্রাস

দাবির স্লোগান তাদের কর্ণকুহরের ত্রাস

মানচিত্র চাইলে তারা বলে বিচ্ছিন্নতাবাদ

অথচ স্বাধীনতায় লড়াই একমাত্র মতবাদ।

 

তারা যুদ্ধ চায় না, তারা শান্তি চায়। শিশুহত্যা যোদ্ধা নির্মূলের পথ।

 

মানুষের অস্থি আজ জনপ্রিয় জ্বালানী

সিমান্তে সিমান্তে ঝুলছে অযুত ফেলানী

সন্তানের দেশ মানে যেমন মায়ের কোল

মুক্তি মানেও তেমনি স্বাধীনতারই বোল।

 

প্রতিটা প্রান্তরে প্রতিটা ভাঙ্গা বুকের দীর্ঘশ্বাসে এক রকম ঘ্রাণ

হারিয়ে ফেলা লাখো ছেলের স্মৃতি, একই কাঁদছে মায়ের প্রাণ।

 

প্যালেস্টাইনের মেয়ে

সাইয়েদ জামিল

 

রওছা আমার বন্ধু। ও প্যালেস্টাইনের

মেয়ে। অন্তর্জালে আমাদের পরিচয়। পরিচয়ের

প্রথম দিনেই ও আমাকে বলে, ‘ইশ! আমি যদি

তোমার কবিতা হতাম!’ এরপর একরাশ হতাশা

আর দীর্ঘ নিস্তব্ধতা! রওছা আবার বলে,

‘আমাকে বিয়ে করবে? তুমি তো কবি, জানি তুমি

ভালোবাসো সুন্দর। হে কবি, আমাকে উদ্ধার

করো। আমিও তো সুন্দর। ভালোবাসো

আমাকে। আমি এই প্যালেস্টাইন ছেড়ে যেতে

চাই। এই যুদ্ধবিধ্বস্ত মানচিত্র থেকে আমি মুক্তি

চাই। এই হত্যা এই ধ্বংসযজ্ঞ আমাকে ক্রমশ

বিকারগ্রস্ত ক’রে দিচ্ছে। আমি একটি নতুন

মানচিত্র চাই। দোহাই কবি, আমাকে একটি

মানচিত্র দাও। যেখানে রক্তপাত নেই। যুদ্ধের

বীভৎসতা নেই। আমাকে এই নরক থেকে নিয়ে

যাও তোমার বাঙলায়। শান্তির কসম, কবি,

আমি তোমার চিরকালের দাসী হবো।’

 

যেহেতু আমি প্যালেস্টানের ইতিহাস জানি

আর যেহেতু আমি মুসলমান,

আমি রওছাকে বললাম, ‘বোন, আমি তোমাকে

ভালোবাসি। শোনো, সারা পৃথিবীই আজ

যুদ্ধবিধ্বস্ত। কোথাও শান্তি নেই। যে প্যালেস্টাইন

থেকে তুমি বের হ’তে চাইছো, সেই অপহৃত

মানচিত্র থেকে তুমি কোন্ মানচিত্রে যেতে

চাও! পুব থেকে পশ্চিম আমাদের সকল

মানচিত্র আজ বেদখল হ’য়ে গেছে। দ্যাখো,

যে বাঙলায় আমি আছি, এখানেও

মুক্তির জন্যে যুদ্ধ হয়েছিলো। আমরা লড়েছিলাম

কিন্তু, বোন আমার, আমার উপলদ্ধি হ’লো

মুক্তির যুদ্ধ কখনও থেমে যায় না। যুদ্ধ থামে নি

এই জনপদেও। এখানেও আমরা

শান্তিতে নেই। সংবাদপত্র খুললে রোজই

খুন আর ধর্ষণের খবর। শান্তির ধর্মকে এখানে

পণ্য বানিয়ে বাণিজ্যের পসরা সাজিয়েছে

লোভী আর চতুর রাজনীতিক। ফলে, ভাইয়ের

বিরুদ্ধে ভাই হাতে তুলে নিয়েছে অস্ত্র। ভাইয়ের

বিরুদ্ধে ভাই ঘৃণা বর্ষণ করছে। আর সকলেই

ইতিহাস ভুলে গেছে। ইতিহাস ভুলে যাওয়া জাতি

মুখ থুবড়ে প’ড়ে থাকে নর্দমায়। চিরকাল

এ-রকমই দেখেছি আমরা।’

 

মন্ত্র-মুগ্ধের মতো কথাগুলো শুনলো

রওছা। অন্তর্জালের এপার থেকেও

আমি বুঝতে পারলাম রওছা মনোযোগী

শ্রোতা। আমি বুঝতে পারলাম,

বিষাদের কালো অক্ষরগুলি ওর হৃদয়কে

নাড়া দিলো। যেনো ও সঙ্গীবিহীন

শাদা এক কবুতর। উড়ছে নীড়হীন

আকাশের প্রচ্ছদে।

 

‘আমরা কি আমাদের ইতিহাসের দিকে

আবার কখনও ফিরে যেতে

পারবো?’— প্রশ্ন করলো রওছা

‘নিশ্চই আমরা পারবো’— বললাম আমি,

‘ইতিহাস আমাদেরই দিকে

তাকিয়ে আছে। এই পৃথিবীর প্রতিটি

জনপদে আবার উড়বে শান্তির পতাকা

বিপর্যস্ত সময়ের পরে শান্তি অনিবার্য হ’য়ে

ওঠে। সাম্যবাদ অনিবার্য হ’য়ে ওঠে

মনে রেখো,

অনিবার্যতাই ইসলামের আবির্ভাব ঘটিয়েছিলো

মানুষকে মুক্তি দিতেই নবী মহমমদ

আল্লার বাণী ছড়িয়ে দিয়েছিলো মানুষের অন্তরে

ক্রীতদাসকে মুক্তি দিয়েছিলো

সুন্দরের দিকে মানুষকে ডেকেছিলো

ভাবো,

সেই সুন্দরের ডাক

সেই আহ্বান

সেই আজান

সেই সত্য স্বর

যা শুনলে এখনও কী রক্তে দোলা দিয়ে ওঠে না

মনে রেখো, আমরা মুসলমান

আমাদের কোনো দেশ নেই

পৃথিবীই আমাদের দেশ

পৃথিবীকে ভালোবেসে এখানেই

রচনা করতে হবে আমাদের

আগামীর নতুন ইতিহাস।’

 

এরপর, রওছার সঙ্গে প্রায়শই দীর্ঘ

আলাপ হ’তো

ও হিজাব পরতো। আমি ওকে ঢাকার

জামদানি পাঠিয়েছিলাম। ক্যানোনা নেট সার্চ

ক’রে ও বাঙালি নারীদের দেখেছিলো। আর

আমার কাছে শাড়ি পরার তীব্র ইচ্ছা

ব্যক্ত করেছিলো।

 

রওছা যখন মেডিকেল থার্ড ইয়ারে

পড়তো, তখন ওর নিরপরাধ ভাই

বর্বর ইসরাইলি সেনার গুলিতে

মারা যায়। ওই সময়টাতেই, ওর বাবা

চাকরি থেকে রিটায়ার্ড করেন। আর

ওর মা অসুস্থ হ’য়ে শয্যাশায়ী হন। পারিবারিক

ও রাষ্ট্রিক ওই ভয়াল বিপর্যয়ের ভেতর রওছাকে

ঘুরে দাঁড়াতে হয়। রওছা আমার কাছে এক

অগ্নিকন্যার ইতিহাস।

 

রওছা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তো

ভদ্র আর নম্র মেয়ে। আমি ওকে

জানিয়েছিলাম, ‘আমি হলাম এমন মুসলমান,

যে, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে না’

শুনে রওছা বলে, ‘তুমি কবি, আল্লা তোমাকে

মাফ কোরে দেবেন। শোনো, আমি শেখ সাদীর

গল্প জানি। আমি জানি, আল্লা কবিদের

ভালোবাসেন। আমাদের নবীও কবিদের

সম্মান করতেন’—

ব’লে ও হাসির ইমো পাঠায়।

আমিও হাসি। আমার হাসির শব্দ

দিগন্ত পেরিয়ে চ’লে যায় অন্য শতাব্দীর দিকে।

 

সেই দূরের শতাব্দীতে রওছা আমাকে বলে,

‘প্যালেস্টাইন হ’লো শান্তির পয়মন্ত ভূমি

কবি, তোমাকে দাওয়াত। তুমি এই

শান্তির পয়মন্ত ভূমিতে কবিতা পড়তে এসো

শোনো, আমি এখানেই সংসার পেতেছি

আমার দুটো বাচ্চা এখন। স্বামী সংসার নিয়ে

সুখেই আছি। তুমি সত্য বলেছিলে কবি, প্যালেস্টাইন

পৃথিবীর সব শান্তিপ্রিয় মানুষের হৃদয়ের ভেতর

বহু শতাব্দী ধ’রে জেগেছিলো কবিতা আর

সংগীত হ’য়ে, যা বুঝতে আমাদের দীর্ঘ সময়

লেগেছে। আমাদের অনেক প্রাণ ঝ’রে গেছে। প্রাণের

পবিত্র বেদি এই রক্তিম ভূমি। এই প্যালেস্টাইন।’

 

ইন্তিফাদা

ফিলিস্তিনে আমার ভাইয়েরা

রুদ্রাক্ষ রায়হান

 

কুদস ধংস হোক!

শায়খ্ আপনি হালাল শুরায় জিভ ছোঁয়ানোর ফতোয়া জারি করুন

আসুন সবাই পুটলি কাঁধে পিকনিকে যাই

আপনি বরং চারটা বিবি রাখার ফন্দি করুন।

রোম পুড়লে নিরোঁর যত দোষ

শালা কেন অযথা বাঁশী ফুঁকে?

শায়খ আপনি ভীষন দু:খ করুন

কাঁদুন, হাগুন, পাঁদুন, ব্যাথা শোকে।

শায়খ, তেল বেচুন

শায়খ, তেল ঘষুন

শায়খ, তেলতেলে খঞ্জর হাতে ভাতারের সাথে নাচুন।

দাউদের রবের কসম

সোলাইমানের রবের কসম

কসম, বাধ্য জ্বীন যার উপাসনা করে

ইন্তিফাদায় যাবো।

জেরুজালেম আমার

আমি আবাবিল ডেকে আনছি

জেদ্দা, রিয়াদ, কায়রো, গুঁড়িয়ে দেব

আপনাদের নরকে পাঠানোর পর, তুড়ি মেরে তেল আবিব উড়িয়ে দেব।

 

ফিলিস্থিনের জন্য এলিজি

জাহিদুর রহিম

 

সৌন্দর্যরা যে সাত বোন, তার মধ্যে বিষন্নতমের নাম জেরুজালেম। প্রিয়তমা তোমার মনে আছে জেরুজালের স্মৃতি? শহরের হাজার বছরের পুরনো পথে আমরা হেটেছিলাম একবার-আকাশ নেমে এসেছিল কাছে-তারাগুলো যেন হাতের নাগালে। তোমার অনামিকায় যদি সেই তারাদের দিয়ে আংটি বানিয়ে দিতে পারতাম।

মনে আছে নাবলুসে কথা-সেখানে বসন্তের মিষ্টি হাওয়ায় গাছের পাতাগুলো ফুলের মতো বর্ণিল হয়ে ফুটে ছিল। আমি দেখেছি- জলপাই পাতাগুলো, ফল আর ফুলগুলো রক্তে ভরে আছে- পাখির চোখেও বোবা অভিমান, বসন্তেও বিষন্নতার কান্না ঝরে যেন অবিরাম।

 

তোমাকে বলেছিলাম এই শহরের প্রাচীন ইতিহাস; দ্রুজ-ম্যারেনাইট-ক্যাথলিক আর পোটেস্টেন্টদের কথা, বলেছিলাম ইহুদিদের ইতিহাস। বলেছিলাম, সভ্য ও আধুনিক পৃথিবীর বিশ্বাসের সব রাজপথ অতিক্রম করেছে এই শহরের বুক। বাতাসে নয় হাজার বছরের পুরনো আতরের ঘ্রাণ, আকাশে পৃথিবীর প্রথম সূর্যের রোদ, জলপাই বাগান চোখের প্রশান্তি নিয়ে ভুমধ্যসাগরের বাতাসে দুলছে। এই শহরে জন্ম নেয় দুনিয়ার সবচেয়ে সাহসী সন্তানেরা- প্রজাপতির মতো, মেঘের মতো, পাখির মতো ঝলমলে রোদের মতো দুরন্ত স্বাধীন সন্তান তারা।

 

হেব্রনের এক বেহেশতের ফুলের মতো নীল চোখের মেয়েকে বলেছিলাম, ‘কি ভালো লাগে তোমার, এই দুনিয়ায়? ‘সে অনাবিল হেসে বলেছিল- ‘পাখি’। আরবের মেয়েদের চেয়ে মিষ্টি করে এই দুনিয়ায় আর কে হাসে? তবু আমি চোখে প্রশ্ন নিয়ে চেয়ে থাকায়- সে আবার বলেছিল, ‘পাখিরা মুক্ত, যেখানে খুশি উড়ে যেতে পারে তারা।’

 

আমি অনেক নির্জন একাকী নির্বাক ঘুরেছি জেনিন- রামাল্লায়। জেনিনে পেয়েছিলাম অযাচিত ভাবে এক বৃদ্ধ আরবের স্নেহের শীতলতা। ফেরার সময় বলেছিলেন, ‘যার দেশ নেই দুনিয়ায়, তার বেচে থাকার কি দাম বলতে পারো?’ আমি কিছুই বলিনি, চুপ থেকেছি। শায়েখ বলেছিলেন, মাতৃভূমি যখন বেদখল হয়, সুখ তখন শোকের মতো। আর স্বাধীনতা এক আজন্ম সংগ্রাম।

 

রাতের পর রাত জেরুজালেমে হেটে দেখেছি স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা প্রজন্মের পর প্রজন্ম কত যত্নে লালন করে চলে মানুষ। দুনিয়ার সবাই বলে, ফিলিস্তিন পরাধীন, কিন্তু আমি জেনেছি, একমাত্র তারাই স্বাধীন। আজ ফিলিস্থিন ইহুদি সমস্যার চেয়ে আরও উন্মুক্ত আর ঐতিহাসিক মূহুর্তে দাঁড়িয়ে। আধুনিকতার সবচেয়ে কদর্য রূপ, ন্যায় অন্যায়ের যেকোন চিরন্তন রূপ নিয়ে মানবতার কাঠগড়ায় একদিন বিচার হবে আমেরিকা আর ইহুদিদের-যেদিন সত্যিই ইমাম আসবেন।

 

আমাদের জানাজা হোক আল-আকসায়

মুহিম মাহফুজ

 

ইতিহাস সাক্ষী, কোনো কালেই আমরা সংখ্যায় আস্থা রাখিনি

আমাদের বিশ্বাস ছিল এমন শক্তির ওপর-

সংখ্যা যে শক্তির সংকল্পের অধীন মরিচীকা মাত্র

আমরা সংখ্যার শক্তি অতিক্রম করেছি বদরে

আমরা জেনেছি, কত ক্ষুদ্র সংখ্যা বৃহৎ সংখ্যাকে পরাজিত করেছে আল্লাহর ইচ্ছায়

সংখ্যার আধিক্যে নয়, আমরা এককে আস্থাবান

বিশ্ব জগতের প্রতিটি বস্তু ও ব্যক্তিকে, জীব ও জড়কে সাক্ষী রেখে

আমরা ঘোষণা করেছি- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ

আমরা এমন এক শক্তির কাছে সমর্পণ করেছি আমাদের সমস্ত স্বত্ব ও সত্তা

যার কোন সংখ্যা নেই, শরিক নেই

তিনিই সকল সংখ্যার যোগাত্মক ও বিয়োগাত্মক শরিকানার স্রষ্টা, তিনি অসংখ্যেয়

আমরা তাই ক্ষুদ্র সংখ্যা নিয়ে আক্রমণে উদ্ধত হই গাজায়

আমাদের সংখ্যার স্বল্পতাই সীমাহীন শক্তি হয়ে

অসংখ্য শত্রুকে কুপোকাত করে তেল আবিবে, ওয়াশিংটনে, ব্রিটেনে, প্যারিসে, বার্লিনে…

কুদসের নামে কসম করে আমাদের প্রতিটি শিশু পৃথিবীতে পা রাখে

আমরা বাঁচার জন্য জন্ম নিতে শিখবো কেনো?

শহীদ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা আমাদের বাঁচিয়ে রাখে, এ কোন নতুন কথা নয়

সন্তানের জন্য আমরা রেখে যাই শাহাদাতের উত্তরাধিকার

আল্লাহর সঙ্গে আমাদের সওদা হয়ে গেছে

সমকালের বিনিময়ে আমরা আল্লাহর অনন্ত মহাকাল কিনে নিয়েছি

যেখানে সমাপ্ত করেছিলেন হজরত ওমর

আমরা তারপর থেকে শুরু করতে চাই

যে মিম্বারে দাঁড়িয়ে খুতবা দিয়েছিলেন আইয়ুবী

আমরা তার সামনে নতজানু বসতে চাই

আমরা জিয়ারত করতে চাই ইহুদিদের হাতে শহিদ হওয়া

চার হাজার নবীদের নুরানি কবর, আমাদের পিতারা যেখানে ঘুমিয়ে আছেন

সেখানে যেতে আমরা কোনো বাঁধাকে পরোয়া করি না

তাদের কবর থেকে এখনো গড়িয়ে পড়ছে রক্তের সুগদ্ধ

আতরের বদলে সে গন্ধ কাফনে মেখে আমরা চাই-

আমাদের জানাজা অনুষ্ঠিত হোক আল-আকসার জাইতুন চত্বরে।

এনএ/

banner

এ জাতীয় আরো সংবাদ

প্রকাশক: আবু সায়েম খালেদ
পরিচালক: এইচ. এম. মুহিউদ্দিন খান
আসকান টাওয়ার, ৬ষ্ঠ তলা, ১৭৪ ধোলাইপাড়
যাত্রাবাড়ী, ঢাকা-১২০৪
ইমেইল: info@36news24.com
ফোন: 01401 400222