রুপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের ১২৫তম জন্মদিন আজ (১৭ ফেব্রুয়ারি)। ১৮৯৯ সালের এই দিনে বরিশালের ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর উপজেলার বামনকাঠি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বাংলা সাহিত্যের এই কিংবদন্তি। কবি জীবনানন্দ দাশ তার কবিতায় এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেন, যেখান থেকে প্রকৃতি, মানবতাবাদ এবং জীবনদর্শনকে এক নতুন আঙ্গিকে দেখা যায়।
কবি জীবনের শুরু
জীবনানন্দ দাশের শৈশব কাটে একটি সাহিত্যপ্রিয় পরিবেশে। তার মা কুসুমকুমারী দাশ ছিলেন গৃহিণী, তবে তিনি নিজেও কবিতা রচনা করতেন। মা থেকেই কবিতা রচনার আগ্রহ ও অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন জীবনানন্দ। তার পিতা সত্যানন্দ দাশ ছিলেন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। শিক্ষা জীবনে জীবনানন্দ ছিলেন মেধাবী ছাত্র। তিনি ম্যাট্রিকুলেশন ও আইএ পাশ করেন বরিশালে, পরে কলকাতায় বি.এ. ও এম.এ. করেন। কলেজ জীবন থেকেই তিনি কবিতা রচনায় মনোযোগী হয়ে ওঠেন।
কবিতার শুরু
জীবনানন্দ দাশের প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় ১৯২৭ সালে “ঝরাপালক” কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে। তবে তার সাহিত্যকর্মের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো প্রকৃতির প্রতি তাঁর গভীর প্রেম ও শ্রদ্ধা। “রূপসী বাংলা” (১৯৫৭) এবং “ধূসর পাণ্ডুলিপি” (১৯৩৬) তার জীবনের সেরা কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম। এসব কাব্যে তিনি বাংলার প্রাকৃতিক দৃশ্যপট এবং মানুষের জীবনযাত্রার নিঁখুত বর্ণনা দিয়েছেন। জীবনানন্দের কবিতায় যেমন বাংলার স্বপ্নময় প্রকৃতির রূপ দেখা যায়, তেমনি তার মাঝে বিচ্ছিন্নতা ও বিষাদও এক ভিন্ন মাত্রায় ফুটে উঠেছে।
সাহিত্যজীবন
জীবনানন্দ দাশ শুধু কবিতা রচনা করেই ক্ষান্ত হননি। তিনি লেখালেখির মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে এক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ধারা গড়ে তুলেছিলেন। তার কাব্যগ্রন্থের পাশাপাশি গল্প, উপন্যাস এবং প্রবন্ধেও ছিল তার অবদান। “মহাপৃথিবী” (১৯৪৪), “সাতটি তারার তিমির” (১৯৪৮), এবং “বেলা অবেলা কালবেলা” (১৯৬১) তার সৃষ্টির অন্যতম দৃষ্টান্ত। এছাড়া “মাল্যবান” (১৯৭৩), “সুতীর্থ” (১৯৭৭), এবং “জলপাইহাটি” (১৯৮৫) তার উপন্যাসগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
তার গল্পও ছিল পাঠকদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়। জীবনানন্দের সাহিত্যে রয়েছে প্রায় ২০০টিরও বেশি গল্প এবং একটি মননশীল প্রবন্ধগ্রন্থ “কবিতার কথা” (১৯৫৫)। তাঁর লেখায় বাঙালি মানুষের জীবনধারা, সংগ্রাম এবং শ্রেষ্ঠত্বের এক অমলিন প্রতিচ্ছবি উঠে এসেছে।
প্রকৃতির কবি
জীবনানন্দ দাশের কবিতার সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল তার প্রকৃতির নিখুঁত বর্ণনা এবং বাংলার প্রতি গভীর ভালোবাসা। তার কবিতায় যেমন নদী, মাঠ, গাছপালা, আকাশের রূপ এবং রূপসী বাংলার সৌন্দর্য উঠে আসে, তেমনি তিনি মানুষের অস্তিত্বের গভীরতা এবং দুঃখ-বেদনা নিয়ে এক বিস্ময়কর দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করেছেন। “আবার আসিব ফিরে” কবিতার মাধ্যমে তিনি বাংলার প্রতি এমন এক অমর প্রেমের কথা বলেছেন যা যুগযুগান্তর ধরে বাঙালি মননে থাকবে।
জীবনানন্দ দাশ ১৯৫৪ সালে কলকাতায় মৃত্যু বরণ করেন, তবে তার কবিতার মাধ্যমে তিনি আমাদের মাঝে চিরকাল বেঁচে থাকবেন। তাঁর সাহিত্যকর্ম শুধু একটি নির্দিষ্ট সময় কিংবা স্থানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, তা যুগের পর যুগ বাঙালি সংস্কৃতি ও সাহিত্যের অমূল্য রত্ন হয়ে থাকবে। আজ, তার ১২৫তম জন্মদিনে আমরা কবি জীবনানন্দ দাশকে স্মরণ করছি, যিনি তার কবিতার মাধ্যমে বাংলার প্রকৃতির রূপকে জীবন্ত করে তুলেছিলেন।
জীবনানন্দ দাশের কবিতা শুধু আমাদের মনোরঞ্জনই নয়, আমাদের জীবনের গভীর দিকগুলো উপলব্ধি করার শক্তি প্রদান করে। তার ১২৫তম জন্মদিনে আমাদের কাছে তার সৃষ্টি আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে, যা সারা পৃথিবী জুড়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গৌরবের প্রতীক।
এনএ/