বাংলাদেশে নীতির অভাব নেই, কিন্তু অভাব রয়েছে নীতির প্রতি সদিচ্ছা

by hsnalmahmud@gmail.com

ইকবাল জিল্লুল মজিদ >>

স্বাধীনতার ৫৫ বছর পেরিয়ে এসেছে বাংলাদেশ। আমরা আজ গর্ব করি পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, তথ্যপ্রযুক্তিতে অগ্রগতি কিংবা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার মতো বড় অর্জন নিয়ে। কিন্তু এই অগ্রগতির পেছনের বাস্তব চিত্রটা কি সমান উজ্জ্বল? আমাদের রাষ্ট্রীয় নীতিমালার কোনো অভাব নেই—প্রতিটি খাতে আছে কৌশলপত্র, উন্নয়ন পরিকল্পনা ও স্বপ্নময় অঙ্গীকার। কিন্তু প্রশ্ন হলো: বাস্তবায়ন কোথায়?

বিজ্ঞাপন
banner

আমরা এক বিষাদজনক বাস্তবতার মুখোমুখি—বাংলাদেশে নীতি আছে, কিন্তু বাস্তবায়ন নেই। কেন এই বৈপরীত্য? কী কারণে রাষ্ট্র, সরকার এবং রাজনৈতিক নেতৃত্ব বারবার নীতির কাঠামো গড়ে তুলেও তা বাস্তবতায় রূপ দিতে ব্যর্থ হন?

রাষ্ট্রের কাঠামো ও প্রশাসনের মনমানসিকতা

রাষ্ট্রের মূল শক্তি তার প্রশাসন। অথচ সেই প্রশাসন আজ অনেকাংশে দলীয় আনুগত্য আর আত্মীয়প্রীতির বলয়ে আবদ্ধ। আমলারা, যারা জনগণের সেবা করার জন্য নিয়োজিত, তাদের একটি অংশ এখন পরিণত হয়েছেন রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় অবস্থানকারী সুবিধাভোগীতে। ফলে তারা জনগণের প্রতিনিধি নয়, বরং একেকজন ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর ‘ম্যানেজার’ হয়ে উঠেছেন। এতে করে নীতির প্রয়োগ আর নাগরিক অধিকার রক্ষা হয় উপেক্ষিত।

রাজনৈতিক দলের চরিত্র: ক্ষমতা মানে শাসন, সেবা নয়

বাংলাদেশে রাজনীতি এখন মূলত ক্ষমতা দখল ও সংরক্ষণের কৌশলে পরিণত হয়েছে। ক্ষমতায় আসা মানেই যেন নিজের ঘরবাড়ি গোছানো, আত্মীয়স্বজনকে প্রতিষ্ঠিত করা, বিরোধী কণ্ঠ স্তব্ধ করা। নীতি তখন হয়ে ওঠে একটা ‘দেখানোর বিষয়’, কার্যকর করার দায় কেউ নেন না। রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভেতরে নেই সেবামূলক চেতনা, বরং রয়েছে প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করার প্রবণতা।

আত্মীয়প্রীতি ও ব্যক্তিস্বার্থ: নীতিকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেয়

আজ বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় পদে, প্রকল্পে, নিয়োগে, এমনকি তদবিরেও আত্মীয়তা ও ঘনিষ্ঠতার জয়জয়কার। যে ব্যবস্থায় নৈতিকতা নয়, বরং কার ‘লোক’ সে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, সেখানে নীতির বাস্তবায়ন আশা করাটা বোকামি হয়ে দাঁড়ায়। এই আত্মীয়প্রীতি এক ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতিতে রূপ নিয়েছে—যা সৎ ও যোগ্য মানুষদের কোণঠাসা করে, ব্যবস্থাকে করে অকার্যকর।

দুর্নীতি: সবচেয়ে বড় বাধা নীতি বাস্তবায়নে

দুর্নীতি এখন এমন এক ক্যান্সারে পরিণত হয়েছে, যা শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়ন নয়, সামাজিক ন্যায়বিচার, প্রশাসনিক জবাবদিহিতা এবং মানবিক মর্যাদাকেও গ্রাস করছে। নীতির বাস্তবায়নে প্রতিটি ধাপে ঘুষ, কমিশন, তদবির ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ লিপ্ত রয়েছে। ফলাফল—নৈতিকতা হ্রাস পায়, সেবা বঞ্চিত হয় সাধারণ মানুষ, আর রাষ্ট্রের প্রতি আস্থা হারায় নাগরিকেরা।

রাষ্ট্র কেন এই চক্র থেকে বের হতে পারছে না?

১. দলীয়করণ ও অস্থিরতা: প্রতিটি সরকার আসে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে, কিন্তু আগের সব পরিকল্পনা বাতিল করে দেয়। ধারাবাহিকতা না থাকলে নীতির দীর্ঘমেয়াদি বাস্তবায়ন অসম্ভব।

২. দায়িত্বহীনতা ও অনিয়ম: আমাদের অনেক নীতিনির্ধারকই মনে করেন, প্রণয়ন করলেই দায়িত্ব শেষ। বাস্তবায়ন যেন কেবল ফাইলের মধ্যে সীমাবদ্ধ।

৩. জনসচেতনতার দুর্বলতা: সাধারণ মানুষের মধ্যে এখনো ব্যাপকভাবে গড়ে ওঠেনি সচেতন ও সক্রিয় নাগরিক চেতনা। ফলে তারা দাবি তোলে না, জবাবদিহিতাও চায় না।

৪. সুশাসনের অভাব: বিচার ব্যবস্থা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং প্রশাসনের মধ্যে রাজনৈতিক প্রভাব এত বেশি যে কেউ প্রকৃতভাবে দায়িত্ব পালন করলেও তারা হয়রানির শিকার হন।

সমাধানের পথ:

  • বাংলাদেশ যদি সত্যিই তার উন্নয়নের স্বপ্নকে বাস্তবতায় রূপ দিতে চায়, তাহলে প্রথমেই প্রয়োজন—
  • নৈতিক নেতৃত্বের উত্থান, যারা কেবল রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী নয়, নৈতিকভাবে দৃঢ়;
  • জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠান, যারা দলনিরপেক্ষভাবে কাজ করবে;
  • সচেতন ও সক্রিয় জনগণ, যারা দাবি তুলবে এবং অনিয়মের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে;
  • এবং সর্বোপরি, নীতি বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, যা দলীয় সীমার বাইরে দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দেবে।
  • অন্যথায়, আমাদের উন্নয়ন থাকবে কিছু পরিসংখ্যানে, কিন্তু নাগরিক জীবনে সেই উন্নয়নের প্রভাব দেখা যাবে না।

লেখক: পরিচালক, কমিউনিটি হেলথ, রাড্ডা এমসিএইচ-এফপি সেন্টার, মিরপুর, ঢাকা

হাআমা/

banner

এ জাতীয় আরো সংবাদ

প্রকাশক: আবু সায়েম খালেদ
পরিচালক: এইচ. এম. মুহিউদ্দিন খান
আসকান টাওয়ার, ৬ষ্ঠ তলা, ১৭৪ ধোলাইপাড়
যাত্রাবাড়ী, ঢাকা-১২০৪
ইমেইল: info@36news24.com
ফোন: 01401 400222