হাসান আল মাহমুদ >>
ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক একটি কার্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে দেশে সৃষ্টি হয়েছে তীব্র বিতর্ক ও উদ্বেগ। সরকারদলীয় উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদনের পরপরই আলেমসমাজ, ইসলামপন্থী রাজনীতিক ও সমাজ বিশ্লেষকরা একে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, বিচারব্যবস্থা ও ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ওপর সম্ভাব্য হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখছেন। তাঁরা সরকারকে এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন।
রোববার (২৯ জুন) রাজধানীর তেজগাঁওয়ে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ঢাকায় তিন বছরের জন্য জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয় স্থাপনের লক্ষ্যে একটি সমঝোতা স্মারক (MoU) অনুমোদন দেওয়া হয়।
জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের ওয়েবসাইট অনুযায়ী, কান্ট্রি অফিসের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ, কারিগরি সহায়তা এবং বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে সমন্বয় করেই কাজ করে এই সংস্থা। বর্তমানে বুরকিনা ফাসো, মেক্সিকো, কম্বোডিয়া, ফিলিস্তিন, সিরিয়া, গিনি, লাইবেরিয়াসহ একাধিক দেশে তাদের এমন কার্যালয় চালু রয়েছে।
এই সিদ্ধান্তকে গভীর উদ্বেগজনক আখ্যা দিয়ে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের সভাপতি শাইখুল হাদিস মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক এবং মহাসচিব মাওলানা মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী এক বিবৃতিতে বলেন:
“এই পদক্ষেপ বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা ও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশি হস্তক্ষেপের ঝুঁকি তৈরি করবে। দেশে যখন রাজনৈতিক অস্থিরতা, মানবাধিকার পরিস্থিতি ও বিচারিক স্বচ্ছতা নিয়ে বিতর্ক চলছে, তখন এমন একটি সংবেদনশীল অফিসের অনুমতি দেওয়া আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।”
তারা বলেন, “মানবাধিকার রক্ষা করতে হলে জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণ এবং স্বচ্ছ রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে হবে—বিদেশি সংস্থা এনে নয়। সরকারকে এই MoU প্রত্যাহার করতে হবে এবং জাতীয় স্বার্থে দৃঢ় অবস্থান নিতে হবে।”
ইসলামিক জনকল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মুফতি আব্দুল হান্নান ফয়েজী ৩৬ নিউজকে বলেন, ‘জাতিসংঘের এই কার্যালয় মানবাধিকার নয়, বরং পশ্চিমা রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের একটি নতুন কৌশল। এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অনধিকার চর্চা এবং সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের সূচনা। সরকার যদি জনমত উপেক্ষা করে এ সিদ্ধান্তে অনড় থাকে, তাহলে আমরা জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক উপায়ে দেশব্যাপী প্রতিরোধ গড়ে তুলব।’
জাতীয় মুফতী বোর্ড ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুফতি খোরশেদ আলম কাসেমী আশঙ্কা প্রকাশ করে ৩৬ নিউজকে বলেন, ‘যেসব দেশে জাতিসংঘ তাদের মানবাধিকার কার্যালয় স্থাপন করেছে, আমরা সেখানে তাদের কার্যক্রম গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছি। দেখা গেছে, মানবাধিকার রক্ষার নামে তারা সেসব দেশের ধর্মীয় বিশ্বাস, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং নৈতিক ব্যবস্থাকে ধীরে ধীরে ক্ষয় করে দিয়েছে। তথাকথিত অধিকারের নামে এমন অনেক বিষয় প্রমোট করা হয়, যা সেই দেশের সমাজ ও ধর্মীয় মূল্যবোধের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।’
‘আমরা আশঙ্কা করছি, বাংলাদেশেও ঠিক একই ধরনের কার্যক্রম চালানোর অপচেষ্টা হবে। বিশেষ করে পশ্চিমা আগ্রাসী সংস্কৃতি, নারী স্বাধীনতার নামে পরিবারবিনাশী এজেন্ডা এবং সমকামিতার মতো বিষয়গুলোকে আইনগত স্বীকৃতি দেওয়ার চাপ তৈরি করা হতে পারে। জাতিসংঘের এই কার্যালয় ভবিষ্যতে আমাদের শিক্ষা, পরিবার, সংস্কৃতি এবং বিচারব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করার পথ তৈরি করতে পারে।’- বলেন তিনি
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ, যার রয়েছে নিজস্ব ধর্মীয় মূল্যবোধ, ঐতিহ্য ও সামাজিক কাঠামো। এসব ধ্বংস করে পশ্চিমা আদর্শ চাপিয়ে দেওয়ার যেকোনো চক্রান্তের বিরুদ্ধে আমাদের সতর্ক ও প্রতিরোধমূলক অবস্থান নিতে হবে। তাই সরকারকে বলব—এ সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করুন, জনগণের অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধা রাখুন এবং জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিন।”
এদিকে পয়ামে ইনসানিয়্যাত বাংলাদেশের আমির ড. শহীদুল ইসলাম ফারুকী ৩৬ নিউজকে বলেন, ‘ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় স্থাপন শুধু একটি প্রশাসনিক বিষয় নয়, বরং এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মূল্যবোধের বিরুদ্ধে একটি সুপরিকল্পিত আগ্রাসন। তাদের প্রকৃত এজেন্ডা হলো—এলজিবিটিকিউ, নারী স্বাধীনতার নামে পরিবারবিনাশী সংস্কৃতি ও ধর্মনিরপেক্ষতা চাপিয়ে দেওয়া। সরকার যদি এ সিদ্ধান্ত থেকে না সরে আসে, তাহলে এটা প্রমাণ হবে—তারা পশ্চিমা এজেন্ডা বাস্তবায়নে নিয়োজিত। যা সদ্য রচিত ‘জুলাই চেতনার’ সাথেও বিশ্বাসঘাতকতা।’
হাআমা/