ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী নেতা মহাবীর শহীদ তিতুমীর রহ.। তিনি নীলকর জমিদার ও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বীরবিক্রমে লড়াই করেছেন। তার বিখ্যাত বাঁশের কেল্লার জন্য তিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন। আজ তার ২৪২ তম জন্মদিন।
শহীদ তিতুমীরের প্রকৃত নাম সৈয়দ মীর নিসার আলী। ১৭৮২ সালে আজকের এ দিনে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশপরগনা জেলার বসিরহাট মহাকুমার বাদুড়িয়া থানার চাঁদপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি।
তিতুমীরের বাবার নাম মীর হাসান আলী এবং মার নাম আবিদা রোকেয়া খাতুন। তার প্রাথমিক শিক্ষা হয় গ্রামের বিদ্যালয়ে। পরবর্তীকালে তিনি স্থানীয় একটি মাদরাসায় লেখাপড়া করেন। ১৮ বছর বয়সে তিনি কোরআনে হাফেজ হন এবং হাদিস শাস্ত্রে পাণ্ডিত্য লাভ করেন। একই সঙ্গে তিনি বাংলা, আরবি ও ফার্সি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন।
১৮২২ সালে তিতুমীর মক্কায় পবিত্র হজ পালনের উদ্দেশ্যে যান। তিনি সেখানে স্বাধীনতার অন্যতম পথ প্রদর্শক সৈয়দ আহমেদ শহীদ রহ. এর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। সেখান থেকে এসে (১৮২৭) তিতুমীর তার গ্রামের দরিদ্র কৃষকদের নিয়ে জমিদার এবং ব্রিটিশ নীলকরদের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়ে আন্দোলন শুরু করেন। তিনি হিন্দু জমিদার কৃষ্ণদেব রায় কর্তৃক মুসলমানদের ওপর বৈষম্যমূলকভাবে আরোপিত ‘দাঁড়ির খাজনা’ এবং মসজিদের করের তীব্র বিরোধিতা করেন। তিতুমীর এবং তার অনুসারীদের সঙ্গে স্থানীয় জমিদার ও নীলকরদের মধ্যে সংঘর্ষ তীব্রতর হতে থাকে।
তিতুমীর বর্তমান চব্বিশ পরগনা, নদীয়া এবং ফরিদপুরের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের অধিকার নিয়ে সেখানে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। স্থানীয় জমিদারদের নিজস্ব বাহিনী এবং ব্রিটিশ বাহিনী তিতুমীরের হাতে বেশ কয়েকবার পরাজয় বরণ করে। তন্মধ্যে বারাসতের বিদ্রোহ অন্যতম। তিতুমীরের অনুসারীর সংখ্যা বেড়ে এক সময় ৫,০০০ গিয়ে পৌঁছায়। তারা সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হয়। ১৮৩১ সালের ২৩শে অক্টোবর বারাসতের কাছে বাদুড়িয়ার ১০ কিলোমিটার দূরে নারিকেলবাড়িয়া গ্রামে তিনি বাঁশের কেল্লা তৈরি করেন। বাঁশ এবং কাদা দিয়ে তারা দ্বি-স্তর বিশিষ্ট এই কেল্লা নির্মাণ করেন।
আগেই তিতুমীর পালোয়ান হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন এবং পূর্বে জমিদারের লাঠিয়াল হিসাবে কর্মরত ছিলেন। তিনি তার অনুসারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তোলেন।
অবশেষে ১৮৩১ সালের ১৩ নভেম্বর ব্রিটিশ সৈন্যরা তাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। তিতুমীর স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়ে বললেন, ‘ভাই সব, একটু পরেই ইংরেজ বাহিনী আমাদের কেল্লা আক্রমণ করবে। লড়াইতে হার-জিত আছেই, এতে আমাদের ভয় পেলে চলবে না। দেশের জন্য শহীদ হওয়ার মর্যদা অনেক। তবে এই লড়াই আমাদের শেষ লড়াই নয়। আমাদের কাছ থেকে প্রেরণা পেয়েই এ দেশের মানুষ একদিন দেশ উদ্ধার করবে। আমরা যে লড়াই শুরু করলাম, এই পথ ধরেই একদিন দেশ স্বাধীন হবে।’
উইলিয়াম হান্টার বলেন, ওই বিদ্রোহে প্রায় ৮৩ হাজার কৃষকসেনা তিতুমীরের পক্ষে যুদ্ধ করেন।
১৪ নভেম্বর কর্নেল হার্ডিং-এর নেতৃত্বে ব্রিটিশ সৈন্যরা ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তিতুমীর ও তার অনুসারীদের আক্রমণ করে। তাদের সাধারণ তলোয়ার ও হালকা অস্ত্র নিয়ে তিতুমীর ও তার সৈন্যরা ব্রিটিশ সৈন্যদের আধুনিক অস্ত্রের সামনে দাঁড়াতে পারেনি। ১৮৩১ সালের ১৪ নভেম্বর ইংরেজ বাহিনী তিতুমীর বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায়।
মুজাহিদরা দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আধুনিক অস্ত্র সজ্জিত ইংরেজ বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয়ে বাঁশের কেল্লায় আশ্রয় নেয়। ইংরেজরা কামানে গোলাবর্ষণ করে কেল্লা সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত করে দেয়। বহুসংখ্যক অনুসারীসহ তিতুমীর যুদ্ধে শহীদ হন। দিনটি ছিল ১৯ নভেম্বর, ১৮৩১। মুজাহিদ বাহিনীর অধিনায়ক গোলাম মাসুমসহ ৩৫০ জন মুজাহিদ ইংরেজদের হাতে বন্দি হন। ১৪০ জন বন্দিকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তার বাহিনীর প্রধান মাসুম খাঁ বা গোলাম মাসুমকে ফাঁসি দেওয়া হয়। বাশেঁর কেল্লা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়।
শহীদ তিতুমীর রহ. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণার উৎস হিসাবে কাজ করেছে। ১৯৭১ সালে ঢাকার মুহাম্মদ জিন্নাহ কলেজকে তার নাম অনুসারে সরকারি তিতুমীর কলেজ নামকরণ করা হয়।
এনএ/